তারিখটা ছিল ২০১৮ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি। দুবাইয়ের হোটেলে বলিউড সুপারস্টার শ্রীদেবীর মৃত্যুর খবরে আহত হয়েছিলেন বহু মানুষ।
কয়েকদিন পরে যখন তার ‘এমবামমেন্ট সার্টিফিকেট’ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের হাতে আসে, তাতে একটা মোবাইল নম্বর লেখা ছিল ।নম্বরটি আশরাফ থামারাসারি নামে এক ব্যক্তির।পরিবারের বদলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তিনি শ্রীদেবীর মরদেহ গ্রহণ করেছিলেন।
এরপর ভারতের কেরালার মানুষ, বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমান শহরের বাসিন্দা ওই ব্যক্তি শ্রীদেবীর মরদেহ দেশে পাঠিয়েছিলেন।
সেসময়, মানে ২০১৮ সালেই তার সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার, পরে আরও বেশ কয়েকবার।
আশরাফ থামারাসারির সাথে শ্রীদেবীর সম্পর্ক নিয়ে ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই কৌতূহল জেগেছে আপনার মনে? কেবল শ্রীদেবী না, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বহু অভিবাসীরই তিনি ‘শেষ বা অন্তিম বন্ধু’।
অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অভিবাসী কারো মৃত্যু হলে, নিজের দেশে পরিবারের মানুষের কাছে বিনা মূল্যে স্বজনের মরদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন আশরাফ থামারাসারি।গত প্রায় আড়াই দশক ধরেই তিনি এ কাজটি করে যাচ্ছেন।
অনন্য এ কাজের বহু স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন, বিগত বছরগুলোতে বহু মানুষের কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা পেয়েছেন, বহু মানুষের আপনার জন হয়ে উঠেছেন তিনি।তাকে বিশেষ সম্মান দিয়েছে ভারতের সরকারও।
যেমন তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা থেকে আমিরাতে শেফের কাজ করতে যাওয়া ঝুনু মণ্ডলেরও ‘শেষ বন্ধু’।
গত বছর মানে ২০২৪ সালের ৩০শে নভেম্বর, বিকেল সাড়ে তিনটে-চারটে নাগাদ ফোনটা এসেছিল সোনিয়া মণ্ডলদের বাড়িতে।
নদীয়া জেলার শান্তিপুরের ওই পরিবারের কাছে দুবাই থেকে ফোনটা করেছিলেন পাকিস্তানের নাগরিক আবেদ গুজ্জার।
“বাবার বন্ধু ছিলেন ওই আবেদ আঙ্কেল। তিনি যখন খবরটা দিলেন, মাথায় তো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল আমাদের!” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঝুনু মণ্ডলের বড় মেয়ে সোনিয়া।
‘মণ্ডল কলকাতা বিরিয়ানি’
ঝুনু মণ্ডল এতই ভাল বিরিয়ানি বানাতেন তিনি যে হোটেলের মালিক তার বানানো ওই বিরিয়ানির নামই দিয়েছিলেন ‘মণ্ডল কলকাতা বিরিয়ানি’, বলছিলেন তার কন্যা।
প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে থাকতেন।
হার্টের সমস্যা নিয়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ঝুনু মণ্ডল। তবে হঠাৎই যে তার মৃত্যুর খবর আসবে, এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি তার স্ত্রী বা দুই কন্যা।
তার কন্যা সোনিয়ার কথায়, “বাবার হার্টে ব্লকেজ ছিল, অপারেশনও হয়। তারপর তো ভালই ছিল, আমাদের সঙ্গে ফোনে কথাও বলত। কিন্তু হঠাৎই আবেদ আঙ্কলের ফোনটা পেয়ে তো আমরা বুঝতেই পারছিলাম না হঠাৎ কী হল!”
এর পরে তাদের চিন্তা হল যে বাবার মরদেহ কীভাবে দেশে নিয়ে এসে মাটি দেওয়া হবে।
“ওই যে আল্লাহতালা বলে একজন আছেন না…. তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিলেন! আবেদ আঙ্কল দিয়েছিলেন আশরাফ স্যারের নম্বর। তারপর আর কিছুই ভাবতে হয় নি, উনিই সব ব্যবস্থা করে সপ্তাহ দুয়েক পরে কফিনে করে কলকাতা এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবার দেহ। আমরা বাবাকে মাটি দিই ১৫ই ডিসেম্বর,” মিসেস মণ্ডলের গলাটা যেন একটু কান্না ভেজা।
যে মানুষটা তার বাবাকে শেষবারের মতো তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন, দেশের মাটিতে কবর দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই ‘আশরাফ স্যার’ এর সঙ্গে যেদিন দেখা করতে ভোর চারটের সময়ে নদীয়ার শান্তিপুর থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা এসেছিলেন সোনিয়া মণ্ডল, সেটাই ছিল এই দুই অপরিচিতের প্রথম সাক্ষাৎ।
‘কেরালায় আমি ট্রাক চালাতাম’
আদতে কেরালার বাসিন্দা আশরাফ থামারাসারি প্রথমবার ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেন ১৯৯৩ সালে। প্রথমে ছিলেন সৌদি আরবে। তার আগে কেরালায় ট্রাক চালাতেন তিনি।
সৌদি আরবে কয়েক বছর থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তবে ১৯৯৯ সালে শ্যালকের সঙ্গে আবারও পাড়ি দেন বিদেশে, এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
আজমান শহরে শ্যালকের সঙ্গেই খুলেছিলেন একটা গাড়ির গ্যারাজ।
এমনিতে হয়তো পরিচিত মহল ছাড়া আর কারোরই তাকে চেনার কথা নয়। তবে এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে।
কারণ – ওই যে শিরোনামে লিখেছি – তিনি হয়ে উঠেছেন অভিবাসীদের ‘শেষ বন্ধু’।
বলিউডের সুপারস্টার শ্রীদেবীর পরিবারের হোক বা আমিরাত – সৌদি আরবের পরিচিত মানুষরা হোন বা কয়েক হাজার মাইল দূরের পশ্চিমবঙ্গের এক মফস্বল শহর শান্তিপুর থেকে দুবাইতে শেফের কাজ করতে যাওয়া ঝুনু মণ্ডল – কয়েক হাজার মানুষের, বা বলা ভালো অভিবাসীদের পরিবারগুলির শেষ ভরসা হয়ে উঠেছেন এই ব্যক্তি।
প্রায় আড়াই দশক ধরে কোনও অর্থ না নিয়েই আশরাফ থামারাসারি মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে মৃত অভিবাসীদের দেহ দেশে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে থাকেন। তার দাবি, তিনি ১৫ হাজারেরও বেশি মরদেহ বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়েছেন।এছাড়া হাজার দুয়েক মানুষের মৃতদেহ মধ্য প্রাচ্যেই দাফন এবং সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন।
যেসব জায়গায় তিনি মৃত অভিবাসীদের দেহ পাঠিয়েছেন, তার সিংহভাগ যদিও তার নিজের রাজ্য কেরালার, তবে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, আসামের মতো ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে যাওয়া অভিবাসীদের মরদেহও আছে।
এমনকি বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানেও সেসব দেশের মানুষের মৃতদেহ পাঠিয়েছেন তিনি।এর বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা আর আফ্রিকার নানা দেশের মৃত অভিবাসীদের দেহও তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি।তিনি যেসব পরিবারের ‘শেষ বন্ধু’ হয়ে উঠেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন সব ধর্মের, বহু দেশের মানুষ।
যেভাবে শুরু
সেটা ছিল ২০০০ সাল। আমীরাতের আজমান শহরে গ্যারাজ মালিক আশরাফ থামারাসারি গিয়েছিলেন শারজার হাসপাতালে এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে।
তিনি যখন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসছেন, তখনই লক্ষ্য করেন যে দুই যুবক কান্নাকাটি করছেন। ওই দুই যুবককে দেখে মি. থামারাসারির মনে হয়েছিল যে তারা সম্ভবত তার নিজের রাজ্য কেরালার বাসিন্দা।
“আমি তাদের কাছে গিয়ে জানতে চাই যে কী হয়েছে, কাঁদছো কেন?” তারা জানায় যে তাদের বাবা মারা গিয়েছেন, এখন মরদেহ দেশে নিতে কীভাবে কী করতে হবে, তা নিয়ে তাদের কোনও ধারণাই নেই।
“আমার নিজেরও যে এই পদ্ধতিটা নিয়ে কোনও ধারণা ছিল তা নয়। কোনওদিন এমন কিছু করতে হয় নি আমাকে। তবু আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম যে তাদের সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এই কথাটাতেই ওদের মুখটা যে কী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল,” বলছিলেন আশরাফ থামারাসারি।
স্থানীয় আরবদের কাছে জিজ্ঞাসা করে মৃতদেহ দেশে পাঠানোর পদ্ধতি জেনে নিয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলছিলেন, “প্রথমে পুলিশকে খবর দিই। সেখান থেকে ছাড়পত্র নিয়ে দূতাবাসকে জানাই বিষয়টা। আমাকে বলা হয় যে ওই মৃত ব্যক্তির ভিসা বাতিল করাতে হবে।
এইসব কাজকর্ম করতে পাঁচদিন কেটে যায়। এই ক’দিন তাদের বাবার দেহ মর্গে রাখা হয়েছিল। অবশেষে সব কাজ মিটিয়ে পঞ্চম দিনে দুবাই থেকে প্লেনে চাপিয়ে দেহটি রওনা করি।”
এই কদিন কাজ বন্ধ রেখে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির মৃতদেহ দেশে পাঠানোর ঘটনা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ফলেই কদিন পরে আবারও তার ডাক পড়ল।
পশ্চিমবঙ্গের এক যুবক মারা গেছেন, তার দেহও ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তার দেহ নিয়ে আসার মতো কেউ ছিল না। তাই আশরাফ থামারাসারি নিজেই বিমানের টিকিট কেটে কফিন বন্দী দেহ নিয়ে পৌঁছিয়েছিলেন কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে।
মি. থামারাসারি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিমানে চাপিয়ে মৃতদেহ পাঠিয়ে দিই, তবে অনেকবার নিজেও দেহ নিয়ে এসে পৌঁছিয়ে দিয়েছি পরিবারের কাছে। আর তা করতে গিয়ে অনেকবার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে।”
“শ্রীদেবীর মতো বিখ্যাত ব্যক্তির বা একেবারে অপরিচিত মানুষের দেহও যেমন পাঠিয়েছি, তেমনই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দেহ-ও আমাকে পাঠাতে হয়েছে দেশে – তার পরিবারের কাছে,” তিনি বলেন।
থানার লক আপে তিনদিন…
নিজের গাড়িতে ঘোরাঘুরি করে, গ্যারেজের কাজ শ্যালকের হাতে ছেড়ে দিয়ে, ঈদের দিনেও পরিবারকে সময় না দিতে পেরে পরিচিত – অপরিচিতদের মৃতদেহ দেশে পাঠানোর জন্য যা করে থাকেন আশরাফ থামারাসারি, তার জন্য কোনও অর্থ নেন না তিনি।
তাহলে তার চলে কী করে?
বললেন, “কিছু সহৃদয় ব্যক্তি কখনও সখনও ডোনেশন দেন, আবার কোনও এনজিও হয়তো কিছু অর্থ দিল। আর গ্যারেজের কাজ শ্যালকের হাতে দিয়ে দিয়েছি – সে মাসিক একটা অর্থ দেয় পরিবার প্রতিপালনের জন্য।
“এই দিয়েই চলে যায় আমাদের। তবে এই যে মরদেহ দেশে পাঠানোর কাজ, এর থেকে একটা দিরহামও আমি নিইনি কোনওদিন। অনেকেই বলেছে যে কেন আমি প্রতিদান হিসাবে কোনও অর্থ নিই না। অনেকে আছে যারা এই একই কাজ করে অর্থ রোজগার করে। তবে আমি কিছু নেব না – এটা আমার প্রতিজ্ঞা।”
তবে আশরাফ থামারাসারি বলছিলেন, এই অর্থ না নেওয়া নিয়ে কয়েকটা বিচিত্র অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার।
ভারতের ওড়িশা রাজ্য থেকে আমিরাতে কাজ করতে যাওয়া এক ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার দেহ দেশে নিয়ে আসতে হবে। সেখানে ওই ব্যক্তির বিশেষ কোনও পরিচিত ছিল না যিনি এ কাজের দায়িত্ব নেবেন।
সেবার ওই পরিস্থিতি সামলাতে মি. থামারাসারি নিজেই কফিনসহ টিকিট কেটে বিমানে চেপেছিলেন।
“ওই ব্যক্তির পরিবারের দু-তিনটে ফোন নম্বর ছিল। আমি দুবাই থেকে বিমান ওড়ার আগেও কথা হয়েছিল যে তারা ওড়িশার ভুবনেশ্বরে আসবেন দেহ নিতে। এখানে এসে দেখি ওই নম্বরগুলোর একটাও কেউ ধরছে না। এদিকে ওই ব্যক্তির বাড়ি অনেকটা দূরে।
আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে সেখানকার থানায় চলে গেলাম। আমি আগে কখনও ওড়িশা আসিনি, ভাষাও জানি না। তবে পুলিশকে সব খুলে বলতে তারা বললেন অপেক্ষা করুন – আমরা খোঁজ করে দেখছি তার বাড়ি কোথায়।”
আশরাফ থামারাসারি বলেন,”আমি তো বসেই আছি থানায়। রাত হয়ে গেল। কিছু খাবার খেয়ে থানার লক আপে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিল পুলিশ। কী একটা পরিস্থিতি সেই রাতে – বিনা দোষে আমি লকআপে।”
এরপর আরও দুইদিন থানায় অপেক্ষা করে নিজের নম্বর পুলিশকে জানিয়ে যেই মাত্র দুবাইতে ফিরেছেন তিনি, তখনই ওড়িশার সেই থানা থেকে ফোন আসে।
পুলিশই জানায় যে ওই মৃত-ব্যক্তির পরিবার নাকি সমানে নজর রেখেছিল থানায়, আশরাফ থামারাসারির ওপরে।
তারা ভেবেছিল যে দুবাই থেকে বিমানে চাপিয়ে মরদেহ নিয়ে গেছেন – নিশ্চয় পরিবারের কাছে টাকা চাইবেন মি. থামারাসারি।
তিনি বলছিলেন, “পুলিশের যে অফিসার ফোন করেছিলেন তিনি বললেন যে পরিবারটি এতটাই গরীব যে তাদের দাফন করার অর্থও নাকি নেই – তাই টাকা দিতে হবে – এই ভয়ে সামনে আসতে পারেনি।”
থামারাসারিকে নিয়ে বই
মি. থামারাসারিকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন কেরালার পরিচিত সাংবাদিক ও লেখক জি প্রজেশ সেন।
‘দ্য লাস্ট ফ্রেন্ড – দ্য লাইফ অফ আশরাফ থামারাসারি’ নামের বইতে এরকমই আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখিত আছে।
একবার যুক্তরাজ্যের এক অভিবাসীর মৃত্যুর পরে তার দেহ নিতে তার স্ত্রী এসেছিলেন দুবাইতে।
ওই ভদ্রমহিলা বিমান বাহিনীর পাইলট ছিলেন। সব আনুষ্ঠানিকতার শেষে তারা যখন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন, তখন তিনি মি. থামারাসারির দিকে পাঁচ হাজার ডলার এগিয়ে দেন।
“আমি যখন বলেছি যে এটা নিতে পারব না, তখন তো তিনি বেশ চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।”
বইয়ে আশরাফ থামারাসারিকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, “তিনি ভেবেছিলেন যে পরিমাণটা বোধহয় খুব কম হয়ে গেছে। তার স্বামীর প্রতিষ্ঠানের একজন সুপারভাইজার তখন তাকে বোঝান যে বেশি-কমের প্রশ্ন না, আমি কোনও অর্থই নিই না। এবার ওই ভদ্রমহিলা তো কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন আমার হাত জড়িয়ে ধরে।”
ভারত সরকারের সম্মান
প্রায় আড়াই দশক ধরে বিনা পারিশ্রমিকে কয়েক হাজার অভিবাসীর মরদেহ তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করার স্বীকৃতি হিসেবে ভারত সরকার মি. থামারাসারিকে ২০১৫ সালে ‘প্রবাসী ভারতীয় সম্মান’-এ ভূষিত করেছে।
নিজ নিজে ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য প্রতিবছর এই সম্মাননা দেয় ভারত সরকার।
এই ‘সম্মান’ পাওয়ার ঘটনা নিয়েও একটা কাহিনীর উল্লেখ রয়েছে তাকে নিয়ে লেখা জি প্রজেশ সেনের বইটিতে।
উত্তর ভারতীয় একটি পরিবারের ১২ বছরের এক কন্যা শিশু তাদের বাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। আশরাফ থামারাসারির ব্যবস্থাপনায় দেহ ফেরত পাওয়া যায়।
“ওই শিশুটির সৎকার আমিরাতেই হবে। কিন্তু আমি ওই পরিবারটির ধর্মীয় রীতি নীতি জানতাম না। কয়েকজনের কাছে খোঁজ করে তাদের সৎকারের রীতি নীতি জেনে নিই।
এই ঘটনাটা আমাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে তার বাবা-মাকে ছেড়ে শ্মশান থেকে চলে আসতে পারি নি আমি,” বইটিতে মি. থামারাসারিকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে।
“আমি তখনও শক কাটিয়ে উঠতে পারি নি, ভারতীয় দূতাবাস থেকে একটি ফোন এল। যে অফিসার ফোন করেছিলেন, তিনি কোনও একটা সম্মানের কথা বলেছিলেন।
আমি বলে দিয়েছিলাম যে কোনও সম্মান বা পুরস্কার কেনার মতো অর্থ নেই আমার। তিনি বললেন যে দূতাবাসে আসার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া আছে তো? তাহলেই হবে,” লেখক জি প্রজেশ সেনকে জানিয়েছেন মি. থামারাসারি।
দূতাবাসে যাওয়ার পরে দিল্লির বিমানের টিকিট ও একটি চিঠি তুলে দেওয়া হয় তার হাতে।
দিল্লিতে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি ওই সম্মান তুলে দিয়েছিলেন।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও তার কথা হয়েছিল। পরে মি. মোদী একবার দুবাইতে গিয়েছিলেন, দূতাবাস মি. থামারাসারিকে আহ্বান জানিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য।
তবে তিনি সেসময়ে একজনের মরদেহ নিয়ে ভারতে এসেছিলেন।
পরে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করে এই মরদেহ বহনের খরচ নিয়ে একটা অভিযোগ তুলেছিলেন আশরাফ থামারাসারি।
তার কথায়, “অন্য অনেক দেশের বিমান সংস্থাই তাদের অভিবাসীদের মরদেহ বিনা খরচে বহন করে, কিন্তু আমাদের এয়ার ইণ্ডিয়া খরচ তো নিতই, তার ওপরে সাধারণ মাংস পরিবহনের জন্য যে মূল্য সেই হিসাবে খরচ নিত তারা। মরদেহের ওজন যত, তত কিলো মাংসের দাম নেওয়া হত। এটা অত্যন্ত অমানবিক একটা ব্যাপার ছিল।”
“আমি ওই সম্মান প্রদানের দিনে একবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টা তুলেছিলাম। তিনি সুরাহার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে সুষমা স্বরাজের সামনে বিষয়টা তুলে ধরেছিলাম। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে মরদেহ বহনের ব্যবস্থা তো করা যায়নি, কিন্তু এখন দুই থেকে তিন হাজার দিরহামের একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক মরদেহ বহনের জন্য নেওয়া হয়,” বলছিলেন মি. থামারাসারি।
সম্প্রতি তিনি কলকাতায় এসেছিলেন ভুবনেশ্বর ঘুরে, সেখানেই এবছর বসেছিল প্রবাসী ভারতীয় দিবসের অনুষ্ঠান।
সদ্য প্রয়াত শেফ ঝুনু মণ্ডলের পরিবারের জন্য দুবাই থেকে কোনও সহৃদয় ব্যক্তি কিছু অর্থ সাহায্য পাঠিয়েছেন।
কথার মাঝেই বারবার ফোন আসছিল আশরাফ থামারাসারির কাছে।
“এই যে দেখুন এক ব্যক্তি মারা গেছেন। কেরালার বাসিন্দা। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল শুনলাম। এখান থেকেই ফোনে কথা বলেই মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে সব,” বলছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসীদের ‘শেষ বন্ধু’ আশরাফ থামারাসারি।
অমিতাভ ভট্টশালী
বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা