ডয়সে ভেলে রিপোর্ট : বাংলাদেশকে এড়িয়ে বিকল্প বাণিজ্যপথের লক্ষ্যে ভারত

স্যমন্তক ঘোষ দিল্লি

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ভারত বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে আরো বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। মুহাম্মদ ইউনূসের ‘সেভেন সিস্টার্স’ মন্তব্য এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্রমশ নিম্নমুখী হয়েছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে একাধিক সৌজন্যপূর্ণ চিঠি চালাচালি হয়েছে। ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তারপরেও বরফ গলেনি। দুই দেশই পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সম্প্রতি এই বিধিনিষেধের মাত্রা আরো বাড়িয়েছে ভারত। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এবারের বিধিনিষেধে, বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের ব্যবসার উপর। বাংলাদেশের পোশাক, প্লাস্টিক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসহ একাধিক জিনিসের বিরাট বাজার আছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। বাংলাদেশের স্থলসীমান্ত পার করে সহজেই তার বাজার তৈরি হয়েছে ওই অঞ্চলে। নির্দিষ্টভাবে ভারত বাংলাদেশের ওই মার্কেটটিকে টার্গেট করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এবং এর পিছনে সম্প্রতি চীনে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের একটি মন্তব্য গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে করছেন ভারতের বিশেষজ্ঞরা। বস্তুত, ভারতীয় বাণিজ্যমহলও এই ধারণার সঙ্গে সহমত।

ড. ইউনূসের সেই মন্তব্য

চীন সফরে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ভারতের সেভেন সিস্টার্স অর্থাৎ, উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য ‘ল্যান্ড লকড’। সমুদ্রে পৌঁছানোর কোনো রাস্তা নেই তাদের কাছে। সমুদ্রপথে তাদের একমাত্র ‘গার্জিয়ান’ বাংলাদেশ।

ইউনূসের এই মন্তব্য ভালো চোখে দেখেনি ভারত। কারণ, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন নিয়ে বরাবরই ভারত চিন্তিত। এবং এই রাজ্যগুলির নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা বরাবরই ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত-বাংলাদেশ বর্তমান বাণিজ্য সংকটে কেন উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং ভারত বিষয়টিকে কেবলমাত্র একটি বাণিজ্যের জায়গা থেকে না দেখে একটি সামগ্রিক ভূ-রাজনৈতিক কূটনীতি হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে কেন, সে বিষয়টি নিয়েই এখানে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হবে।

চিকেনস নেক কী

পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের উপর দিকে তাকালে দেখা যাবে, একটি গলার মতো অংশ আছে, যার পশ্চিম দিকে নেপাল, পূর্ব দিকে বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ভুটান। ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার চওড়া এই অংশ পার করলে পৌঁছানো যায় ভারতের উত্তর-পূর্বের আটটি রাজ্যে। সরু এই করিডোরটির নামই চিকেনস নেক, যা শিলিগুড়ি করিডোর নামেও পরিচিত। এর উত্তর-পশ্চিম দিকে সিকিম এবং উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব দিকে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং মিজোরাম। এক কথায় সেভেন সিস্টার্স। চিকেনস নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের একমাত্র যোগসূত্র। এই করিডোর কোনো কারণে বন্ধ হলে, উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ড সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ফলে কৌশলগতভাবে ভারতের কাছে এই করিডোরের গুরুত্ব অপরিসীম।

বস্তুত, এই চিকেনস নেক এবং উত্তর-পূর্ব ভারত এদেশে বরাবরই অত্যন্ত সংবেদনশীল। আবার অন্যদিকে, এই উত্তর-পূর্ব ভারত ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যপথও বটে। একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে মিয়ানমার এবং চীন– উপমহাদেশের প্রাচীনতম বাণিজ্যপথগুলি আছে এই অঞ্চলে। এছাড়াও আছে নেপাল এবং ভুটান। বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষ বাণিজ্য যোগাযোগ আছে। ভারত সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সেই ধমনীটি কেটে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ভারত দেখানোর চেষ্টা করছে, বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল না হয়েও উত্তর-পূর্ব ভারত বিকল্প বাণিজ্য পথ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশকে ‘বাইপাস’ করে ভারত পূর্ব দিকের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে। ভারতের এই পদক্ষেপে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলির একাংশও মনে করছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যেমন বিকল্প রাস্তা তৈরি হওয়া দরকার, তেমনি উত্তর-পূর্ব ভারতের বিকল্প বাণিজ্যপথও তৈরি হওয়া দরকার।

চিকেনস নেকের বিকল্প রাস্তা হিসেবে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই ‘কালাদান প্রকল্পে’ অর্থ বিনিয়োগ করছে। এটি একটি হাইব্রিড প্রকল্প, যেখানে কলকাতা বন্দর থেকে সমুদ্র পথে যুক্ত করা হয়েছে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরটিকে। সমুদ্রপথে বাংলাদেশকে বাইপাস করে ৫৩৯ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে মিয়ানমারে পৌঁছাচ্ছে এই রাস্তা। মিয়ানমার সিতওয়ে থেকে পালেতওয়া পর্যন্ত রাস্তা নদীপথ। কালাদান নদীর মধ্য দিয়ে এই রাস্তার মোট দূরত্ব ১৫৮ কিলোমিটার। পালেতওয়া থেকে মিয়ানমারের কালেতওয়া পর্যন্ত রাস্তার দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। এখান থেকে শুরু হচ্ছে সড়কপথ। কালেতওয়া থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরাম সীমান্ত ৪৯ কিলোমিটার। মিজোরাম থেকে মণিপুর হয়ে এই রাস্তা পৌঁছাবে আসামের শিলচরে। অর্থাৎ, চিকেনস নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর বাইপাস করে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছানোর বিকল্প পথ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই রাস্তাটি একদিকে যেমন ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে জুড়ছে, তেমনই উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যকে সরাসরি যুক্ত করছে কলকাতা বন্দরের সঙ্গে। বস্তুত, বিশাখাপত্তনম বন্দরও এই রাস্তার ভিতরেই পড়ছে।

সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে স্থলবন্দরগুলি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও সমুদ্র বন্দরে কোনো নিষেধাজ্ঞা চাপায়নি। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এর মূল কারণ, সরকার চাইছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্যবসায়ীরা সমুদ্র বন্দরের ব্যবহার বাড়ান। একইসঙ্গে বাংলাদেশকে ভারত দেখাতে চাইছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের সমুদ্রের ‘গার্জিয়ান’ বাংলাদেশ নয়, ভারতই। কালাদান প্রকল্প এই কারণেই এই মুহূর্তে ভারতের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পের অর্থ হলো, বাংলাদেশকে বাইপাস করে মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দর উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য খুলে দেওয়া।

তৃতীয় বিকল্প

কালাদান প্রকল্প নতুন নয়। বহুদিন ধরেই ভারত এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দরটিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই ভারত করে ফেলেছে। প্রকল্পের কাজও শুরু হয়ে গেছে বহুদিন। কিন্তু এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বাইপাস করার কথা আগে ভাবেনি ভারত। তৃতীয় বিকল্পে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যপথ তৈরির পরিকল্পনাও হয়েছিল। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ত্রিপুরার আগরতলার সঙ্গে কলকাতার একটি সরাসরি রেল যোগাযোগ তৈরি করতে চাইছিল ভারত সরকার। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এই প্রকল্পের কাজ অনেকটাই এগিয়েছিল। এর ফলে চিকেনস নেক ব্যবহার না করে, কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা পৌঁছানো সম্ভব ছিল। এই বাণিজ্য পথ ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরো উন্নত করবে বলেই মনে করেছিল ভারতীয় প্রশাসন। কিন্তু ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর এই পথ নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। আগরতলা আন্তর্জাতিক স্টেশন তৈরি হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু রেল চলাচল করছে না।

সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি

বাংলাদেশে হাসিনার সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ রেল প্রকল্প বড় ধাক্কা খেয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দৃশ্যত বদলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগের তৃতীয় বিকল্প এখন কার্যত অথৈ জলে। ফলে কালাদান প্রকল্প আবার নতুন গুরুত্ব নিয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের দুশ্চিন্তার দ্বিতীয় কারণ।

মিয়ানমার পরিস্থিতি

মিয়ানমারে অং সান সুচি-র সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে কালাদান প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল ভারত। কিন্তু তারমধ্যেই সেখানে ঘটে গেছে সেনা বিদ্রোহ। বর্তমানে মিয়ানমারে সরকার চালাচ্ছে সেনা জুন্টা। এই সেনা জুন্টার সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছে একাধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। আরাকান আর্মি যার অন্যতম। কলকাতা বন্দর থেকে মিয়ানমারে যে সিতওয়ে বন্দরে পৌঁছাচ্ছে কালাদান প্রকল্পের প্রথম ধাপ, সেই সিতওয়ে বন্দর আরাকান প্রভিন্সের অন্তর্গত। সেখান থেকে যে রাস্তা পৌঁছাচ্ছে মিজোরাম সীমান্তে, তার কিছুটা অংশ মিয়ানমারের চীন প্রভিন্সের অন্তর্গত। কিন্তু আরাকান আর্মি এই গোটা অঞ্চলটি কার্যত দখল করে নিয়েছে। চীন প্রভিন্সের সামান্য অংশও এখন তাদের দখলে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক অফিসার নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে ডিডাব্লিউ-কে বলেছেন, ”সিতওয়ে বন্দরটি এখনো আরাকান আর্মির দখলে যায়নি। কিন্তু তার নিকটবর্তী সমস্ত জায়গাই তাদের হাতে। ওই অঞ্চল থেকে ভারতীয় শ্রমিকদের একটি বড় অংশকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।” উল্লেখ্য, ওই অঞ্চলে এর আগে একাধিকবার ভারতীয় শ্রমিকদের উপর হামলাও হয়েছে।

মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কালাদান প্রকল্পের কাজের উপর প্রভাব ফেলছে, তা মেনে নিচ্ছে ভারতীয় প্রশাসন। তবে কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

ভারতীয় সেনার প্রাক্তন অফিসার এবং সামরিক-কূটনীতিক কর্নেল শান্তনু রায় ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ”বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বর্তমান সম্পর্ক মাথায় রাখলে কালাদান প্রকল্পের গুরুত্ব বোঝা সম্ভব। চিকেনস নেকের বিকল্প পথ তৈরি এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।” শান্তনু জানিয়েছেন, ভারত বিভিন্ন চ্যানেলে একদিকে মিয়ানমারের সেনার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে, অন্যদিকে রাখাইন এবং চীন আর্মির সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা তৈরি করছে। তবে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কালাদান প্রকল্প যে সমস্যার মধ্যে আছে তা স্বীকার করছেন শান্তনু। রাখাইন অঞ্চলে চীনও যথেষ্ট বিনিয়োগ করছে বলে জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি রাখাইন আর্মিতে চীন প্রভাব তৈরি করছে বলেও মনে করেন তিনি। ফলে মিয়ানমারের অংশে কালাদান প্রকল্প যথেষ্ট সমস্যার মধ্যে আছে।

ভারতীয় সেনার সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ”বাংলাদেশকে ভারত বরাবরই বন্ধু প্রতিবেশী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভারতের কাছে বাংলাদেশের অবস্থানগত গুরুত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না ভারত। চীনে মুহাম্মদ ইউনূসের সেভেন সিস্টার বিষয়ক মন্তব্যও ভারতকে ভাবাচ্ছে। বাংলাদেশের চীনমুখিনতাও ভারতের অন্যতম চিন্তার কারণ। এই পরিস্থিতিতে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কালাদান প্রকল্প ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” উৎপলের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত যে পদক্ষেপগুলি নিচ্ছে, তা কেবল অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক নয়, এর পিছনে ভূ-রাজনীতি এবং কূটনীতি কাজ করছে। উৎপল জানিয়েছেন, মিয়ানমারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলে ভারত আলোচনা চালাচ্ছে। ভারতের প্রথম সারির কূটনীতিকেরা নিয়মিত মিয়ানমারে যাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অনিন্দ্যোজ্যোতি মজুমদার ডিডাব্লিউকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকাকালীন বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল ভারত। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য যোগাযোগ অন্যতম শিখরে পৌঁছাবে বলেই মনে করা হয়েছিল। যে কারণে ২০২৩ সালের মধ্যে কালাদান প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করে ফেলার কথা থাকলেও ভারত তা ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেনি। ওই প্রকল্পে এখনো প্রায় ২৫ শতাংশ কাজ বাকি।

অনিন্দ্যের কথায়, ”বাংলাদেশে পটপরিবর্তনের পর ভারত বুঝতে পেরেছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে তারা। ফলে ভারতের নতুন বাণিজ্যনীতি সাময়িকভাবে উত্তর-পূর্বের ব্যবসায়ীদের উপর প্রভাব ফেললেও বিকল্প রাস্তার দিকনির্দেশ তাদের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ।” এই কারণেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ল্যান্ড পোর্টগুলিকে বন্ধ করে সমুদ্রপথের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনিন্দ্য মনে করেন, খাতায় কলমে কালাদান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। বাংলাদেশকে বাইপাস করে ভারত এই রাস্তায় পূর্ব দিকের দেশগুলিতে বাণিজ্য করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক লড়াইয়ে কালাদান প্রকল্পের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই রাস্তাটিকে চিকেনস নেকের বিকল্প হতে পারবে বলে মনে করেন না অনিন্দ্য। পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক স্থল বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন না তিনি। কারণ, এই বাণিজ্যের উপর দুইপক্ষই অনেকটা নির্ভরশীল বলে মনে করেন তিনি।

তবে বাংলাদেশের বাণিজ্যকে চীন কতটা প্রভাবিত করবে, সেই বিষয়টির উপর ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ভবিষ্যত সূচিত হবে বলে মনে করেন অনিন্দ্য। বাংলাদেশ যত চীনমুখী হবে, ভারতও তত বাংলাদেশকে বাইপাস করে বিকল্প কৌশল নেবে। আর বাংলাদেশ যদি পুরনো সম্পর্কে যেতে চায়, তাহলে ভারতও বাণিজ্য নীতি আগের জায়গায় নিয়ে যাবে– এমনটাই মনে করেন তিনি। অনিন্দ্য এবং শান্তনু দুজনেই মনে করেন, ভারত-বাংলাদেশ বর্তমান বাণিজ্য সম্পর্ক একেবারেই একটি কূটনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক বিষয়। বাণিজ্যকে এখানে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র।

ভারতীয় কূটনৈতিক মহলও মনে করছে, বাংলাদেশে চীন প্রভাব বাড়াচ্ছে। যা চিকেনস নেক করিডোরের সুরক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক। অন্যদিকে কে পি শর্মা ওলি-র আমলে নেপালও চীনের দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে আছে। এই পরিস্থিতিতে চিকেনস নেকের নিরাপত্তা ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কারণে, উত্তরবঙ্গের বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে ভারত রাফালের মতো যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেনা রেজিমেন্ট চিকেনস নেকের একেবারে কাছে অবস্থান করছে। যে কোনো সমস্যায় যাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য সংস্থার অন্যতম কর্মকর্তা অমরেশ রায় জানিয়েছেন, ”বাংলাদেশও তাদের দেশের ভিতর দিয়ে আমাদের জিনিসপত্র যাতায়াতের রাস্তা বন্ধ করেছে। এতে আমাদের খুবই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমরা চাই, ভারত বিকল্প পথের ব্যবস্থা করুক। যা এই অঞ্চলের বাণিজ্যে আরো গতি আনবে। তবে পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের উপর এই অঞ্চলের একটি বড় অংশের মানুষের রুটিরুজি নির্ভর করে। সেই বিষয়টিও মাথায় রাখা দরকার।”

প্রায় একই অভিমত ওই সংস্থার আরেক কর্মকর্তা আতোয়ার রহমানের। তিনি জানিয়েছেন, ”বেশ কিছু বাণিজ্য বন্ধ হলেও অনেক কিছুই এখনো চালু আছে। একটা সমাধানসূত্রে পৌঁছানো জরুরি। তবে বিকল্প বাণিজ্য পথ উত্তর-পূর্বের ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত জরুরি।”

ভারত-বাংলাদেশ বর্তমান বাণিজ্য পরিস্থিতি দুই দেশের ব্যবসায়ীদের উপরেই প্রভাব ফেলছে, সন্দেহ নেই। এই কূটনৈতিক লড়াই কত দূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

পূর্বের খবরবাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটি করতে চায় না চীন, আমেরিকার দাবি ভিত্তিহীন: রাষ্ট্রদূত
পরবর্তি খবরশোয়েব প্রথম স্বামী নন, এর আগেও বিয়ে করেছিলেন দীপিকা! রয়েছে কন্যাসন্তান ও!