সুপ্রিম কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ, মিশ্র প্রতিক্রিয়া

 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের নীতিমালার খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেছেছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিজ্ঞাপন

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের নীতিমালার খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে। সহসাই জারি হবে অধ্যাদেশ।

তবে এই নীতিমালা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আগের চেয়ে পদ্ধতি স্বচ্ছ হবে বলে সাবেক বিচারকরা মনে করলেও সরাসরি পরীক্ষার ব্যবস্থা না রাখায় স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ থেকেই যাবে বলে মনে করেন তারা। তারা আরো বলেন, হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগে আইনজীবী ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের অনুপাত সমান হওয়া দরকার।

কেমন হবে এই কাউন্সিল?

জানাগেছে, সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ এবং প্রধান বিচারপতিকে সহায়তা দিতে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ নামে একটি স্থায়ী কাউন্সিল গঠন করা হবে। পদাধিকার বলে এর চেয়ারম্যান হবেন প্রধান বিচারপতি। তার সঙ্গে কর্মে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ ও বিচার কর্ম-বিভাগে নিযুক্ত হাইকোর্ট বিভাগের একজন করে মোট তিনজন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি হবেন এর সদস্য। এছাড়া কাউন্সিলে থাকবেন চেয়ারম্যান মনোনীত আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল পদাধিকার বলে কাউন্সিলের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে কাউন্সিল। তারা আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দেবে। নিয়োগযোগ্য বিচারকের সংখ্যার অতিরিক্ত যুক্তিসংগত সংখ্যক প্রার্থীর নামসহ একটি তালিকা সুপারিশ আকারে প্রণয়ন ও প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করবে। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন।

অতিরিক্ত বিচারকদের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক নিয়োগ করা হবে। এজন্য কাউন্সিল সুপারিশ প্রণয়ন করে তা প্রধান বিচারপতির কাছে দেবে। চাইলে কাউন্সিল সুপ্রিম কোর্টের কোনো অতিরিক্ত বিচারকের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করতে পারবে। আবার কোনো অতিরিক্ত বিচারক স্থায়ী নিয়োগে অনুপযুক্ত হলে কাউন্সিল তাকে সুপারিশে বিরত থাকতে পারবে।

শূন্যপদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত জ্যেষ্ঠদের আপিল বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগে করা হবে। এজন্য নির্ধারিত নিয়োগযোগ্য বিচারকের সংখ্যার অতিরিক্ত যুক্তিসংগত সংখ্যক নামসহ একটি তালিকা সুপারিশ আকারে প্রণয়ন ও প্রধান বিচারপতির কাছে দেবে। প্রধান বিচারপতি সংবিধানের তার পরামর্শ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন।

নিয়োগে স্বচ্ছতা বাড়বে

সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু ডয়চে ভেলেকে বলেন, “উচ্চ আদালতের বিচারব নিয়োগে যে নীতিমালা করা হচ্ছে এবং আমি যতটুকু জানতে পেরেছে তার ভিত্তিতে বলতে পরি এতে স্বচ্ছতা আরো বাড়বে। কাউন্সিলে সাতজন সদস্য থাকায় সেখানে স্বজন প্রীতি বা রাজনৈতিক প্রভাবের আশঙ্কা কম থাকবে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই বিচারক নিয়োগ হবে বলে আশা করি। ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায়ও এমন আইন আছে।”

তার কথা, “বিচারক নিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা করার কথা ১৯৭২-এর সংবিধানে বলা ছিল। এরপরও কোনো সরকার এই আইন তৈরি করেনি। প্রত্যেকে পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়েছে। সেটা আর সম্ভব হবে না।”

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগ দিতে কাউন্সিল সংবিধানে বর্ণিত ন্যূনতম যোগ্যতার অতিরিক্ত হিসাবে বয়স কোনোক্রমে ৪৫ বছরের নিচে হবে না, দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকতে পারবে না, পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

অধঃস্তন আদালতের বিচারক এবং সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট- এই দুই শ্রেণির প্রার্থীরা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। আইনজীবীদের ন্যূনতম যোগ্যতাসহ প্রার্থীর পেশাগত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম নিশ্চিত করতে হবে। বিচার-কর্মবিভাগের সদস্য হিসেবে ন্যূনতম যোগ্যতাসহ প্রার্থীর বিচারিক আদেশ ও সিদ্ধান্তের মান, আদালত ব্যবস্থাপনা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম যাচাই করতে হবে।

প্রশ্ন আছে তারপরও

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিষ্ট্রার জেনারেল এবং সাবেক বিচার ইকতেদার আহমেদ বলেন, “আসলে এখন পর্যন্ত যা জানি তাতে অস্বচ্ছতার জায়গা রয়েই গেছে। সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। সুপ্রিম কাউন্সিল আর গণবিজ্ঞপ্তি যাই বলেন না কেন পরীক্ষা ছাড়া সঠিক নিয়োগ হবে বলে মনে করিনা। কারণ যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে তাতেও রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকবে।”

“আরেকটি কথা হলো যে এমনও দেখা গেছে সহকারী জজ পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। অধঃস্তন আদালতের বিচারক হতে পারেনি। কিন্তু আইনজীবী হিসাবে উচ্চ আদালতে পরে প্র্যাকটিস করে হাইকোর্টের বিচারপতি হয়েছে। সেখানে মেধা থাকল কোথায়? পরীক্ষা হলে এটা হতো না। যারা নিম্ন আদালতে বিচারক হন তারা তো জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে নানা প্রক্রিয়া শেষ করে তারপর হন। হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগে তাহলে পরীক্ষা হবে না কেন?”

তার কথা, “আরো বৈষম্য আছে। হাইকোর্টের বিচারকদের শতকরা ৮০ ভাগ নেয়া হচ্ছে আইনজীবীদের মধ্য থেকে আর ২০ ভাগ নেয়া হচ্ছে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে। এটা সমান ৫০ ভাগ-৫০ ভাগ হওয়া উচিৎ।”

“অতীতে আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে অধঃস্তন আদালতের ২০৫ জন বিচারক সুপারসিড করে হাইকোর্টের বিচারক করা হয়েছে। কেন সুপারসিড করা হলো তার ব্যাখ্যাও দেয়া হয়নি। সেই পরিস্থিতি এড়ানোর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি,” বলেন তিনি।

তবে ড. শাহজাহান সাজু বলেন, “পরীক্ষার একটা বিধান রাখা হয়েছে। সেটা মৌখিক পরীক্ষা। আর যেহেতু গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে এবং যাচাই বাছায়ের স্তর রাখা হয়েছে ফলে স্বচ্ছতা অবশ্যই আগের চেয়ে বাড়বে। আর আইনজীবী ও অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের মধ্য থেকে কত অনুপাতে নেয়া হবে তাও বলা হয়নি। আশা করি এখানে সাম্য অবস্থা আসবে।”

তবে এই নীতিমালা করার আগেই অন্তর্বর্তী সরকার হাইকোর্টে ২৩ জন অস্থায়ী বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে। ইকতেদার আহমেদ বলেন, “এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা অবসরের পর রাষ্ট্রের কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ পাবেন না। কিন্তু সংবিধান লঙ্ঘন করে এই সরকার সেই ধরনের নিয়োগও দিচ্ছে।”

তবে সাবেক জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক অস্থায়ীভাবে দুই বছরের জন্য নিয়োগ করা হয়। এরপর স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যে ২৩ জনকে নীতিমালা তৈরির আগেই এই সরকার নিয়োগ দিয়েছে তারা যোগ্য না হলে দুই বছর পর তাদের স্থায়ী না করলেই তারা আর থাকতে পারবেন না।”

হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়েস ভেলে

 

পূর্বের খবরএলেন ডিজেনারেস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় জানাচ্ছেন
পরবর্তি খবরBiden leaves office nostalgic about five-decade career, and frustrated by how it ended