রাচিনের ব্যাটে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিদায়

 

 

সপ্তাহ দুয়েক আগে, ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ক্যাচ ধরতে গিয়ে মুখে আঘাত পেয়েছিলেন রাচিন রবীন্দ্র। মাঠ ছেড়েছিলেন রক্তাক্ত অবস্থায়। খেলতে পারেননি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের বিপক্ষের ম্যাচে। দলে ফিরেই ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি এই তরুণ বামহাতি ব্যাটারের। ২৩৭ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৭২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড যখন খানিকটা ব্যাকফুটে, তখনই ১০৫ বলে ১১২ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে দলের জয় নিশ্চিত করেছেন শচীন টেন্ডুলকার আর রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা রাচিন। ফলে ২৭ ফেব্রুয়ারি একই ভেন্যুতে পাকিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচটা হয়ে গেছে নিছক নিয়মরক্ষার।

হারলেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিশ্চিত- এমন ম্যাচে বাংলাদেশ একাদশে আনে দুটো পরিবর্তন।উদ্বোধনী ব্যাটার সৌম্য সরকার ও পেসার তানজিম হাসান সাকিব বাদ পড়েন, তাদের জায়গায় দলে আসেন মাহমুদউল্লাহ ও নাহিদ রানা। মাহমুদউল্লাহকে জায়গা দিতে ওয়ান-ডাউন থেকে ইনিংসের সূচনায় উঠে আসেন শান্ত। টস জিতে নিউজিল্যান্ড বেছে নেয় বোলিং।

ম্যাট হেনরির করা ম্যাচের প্রথম ওভারটা ছিল ঘটনাবহুল। চতুর্থ বলে মিড অনে উড়িয়ে বল পাঠিয়েছিলেন তানজিদ হাসান তামিম, দীর্ঘদেহী উইল ও রুর্ক ঝুঁকে বল ধরতে ধরতে সেটা পড়ে তার ঠিক সামনে। ১ বল পর বল শান্ত’র প্যাডে লাগলে বোলারের আবেদনে আম্পায়ার কুমারা ধর্মসেনা সাড়া না দিলে রিভিউ নিয়েছিলেন অধিনায়ক মিচেল স্যান্টনার। বলটা লেগস্টাম্পের বাইরে পড়ায় বেঁচে যান শান্ত, রিভিউ নষ্ট হয় নিউজিল্যান্ডের। এরপর তানজিদ তামিম ও শান্ত বেশ স্বচ্ছন্দেই সামলাচ্ছিলেন কিউই পেসারদের। কাইল জেমিসনের বলে ডিপ মিডউইকেট দিয়ে একটা দারুণ ছক্কা মারেন তামিম, ১১টা ডট বল খেলার পর ম্যাট হেনরির শর্ট অফ লেন্থের বলেও মারেন দৃষ্টিনন্দন ছক্কা।

বড় কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েও তানজিদ তামিমের ইনিংস শেষ হয়ে যায় ২৪ বলে ২৪ রানে।ম্যাচের ৯ম ওভারে প্রথমবারের মতো কোনো স্পিনারকে বোলিং দেন স্যান্টনার, দ্বিতীয় বলেই উড়িয়ে মারতে গিয়ে কেন উইলিয়ামসনের হাতে ক্যাচ দিয়ে দেন তানজিদ তামিম। নিউজিল্যান্ড দলের বোলিং আক্রমণ নিয়ে ম্যাচের আগে বাংলাদেশ দলের ভিডিও অ্যানালিস্ট নিঃসন্দেহে অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। পেসত্রয়ী কিংবা বামহাতি স্পিনার স্যান্টনারকে ছাপিয়ে নিরীহ দর্শন অফস্পিন করা ব্রেসওয়েলই যে প্রধান ঘাতক হয়ে উঠবেন সেটা হয়তো তার দূরতম কল্পনাতেও আসেনি। তামিমের পর আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান তাওহিদ হৃদয়ও সেই ব্রেসওয়েল-উইলিয়ামসন যুগলবন্দির শিকার। হৃদয় ক্যাচ দিয়েছেন কাভারের উপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে, আউট হয়েছেন মার ৭ রান করে। অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম আউট হয়েছেন চিরচেনা উপায়ে, অফস্পিনারের বলে স্লগসুইপ খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছেন ডিপ মিডউইকেটে।একটু ঝুলিয়ে দেয়া বল ব্রেসওয়েলের, মুশফিকের হাঁটু গেঁড়ে সুইপ আর বাউন্ডারি লাইনে রাচিন রবীন্দ্র’র বিশ্বস্ত হাত। ভারতের বিপক্ষে শূন্যতে আউট হওয়ার পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছেন ২ রান, দলের বিপর্যয়ে ‘অভিজ্ঞ’ ক্রিকেটারের এমন দায়িত্বহীন ব্যাটিং উস্কে দিয়েছে সমালোচনার আগুন। মাংশপেশির চোটের কারণে ভারতের বিপক্ষে একাদশে ছিলেন না মাহমুদউল্লাহ, সোমবার দলে সুযোগ পেয়ে হয়ত মনে মনে বলেছেন, ‘‘কেন মিছে এই কষ্ট!” ব্রেসওয়েলের বলে ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারতে গিয়ে ঠিকঠাক ব্যাটে-বলে করতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ, শর্ট থার্ড ম্যানে উইল ও রুর্ক ক্যাচ নিয়ে নিশ্চিত করেছেন তার বিদায়। মাহমুদুল্রাহ নামের পাশে তখন মাত্র ৪ রান। যে দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছ থেকে প্রত্যাশা বেশি ছিল অধিনায়কের, সেই দুজনই হতাশ করলেন সর্বোচ্চ মাত্রায়।

একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অধিনায়ক শান্ত। ভারতের বিপক্ষে কোনো রান না করে আউট হওয়ার পরের ইনিংসটা যতটা তার দলের মান বাঁচিয়েছে, ততটা তার নিজেরও। ১১০ বলে ৭৭ রানে উইল ও রুর্কের বলে আকাশে ক্যাচ তুলে ইতি ঘটেছে শান্ত’র ইনিংসের। আরেকটু সাবধানী হয়ে খেললে হয়তো সেঞ্চুরিও পেতে পারতেন শান্ত, ইনিংসের তখনো ১২ ওভার বাকি ছিল। এখানেও সেই পুরনো সমস্যাই, বাংলাদেশের ব্যাটাররা কুড়ি-পঁচিশ রানের ইনিংসকে হাফসেঞ্চুরিতে আর হাফসেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরিতে রূপান্তর করতে যে বড়ই অপটু! শান্ত’র বিদায়ে জাকের আলীর ব্যাটে খানিকটা লড়াই জারি রেখেছিল বাংলাদেশ, রিশাদ হোসেনের ২৫ বলে ২৬ রানের ইনিংসটাও ছিল কার্যকর। তবে শেষ বল পর্যন্ত কোনো স্বীকৃত ব্যাটার ছিলেন না ২২ গজে। তাই শেষের ওভারগুলোতে রান এসেছে কম। ২ চার আর ১ ছক্কায় ২৬ রান করে আউট হয়েছেন রিশাদ। স্ট্রাইক নিতে চেয়ে উইকেটরক্ষকের কাছে বল চলে যাবার পরও নন-স্ট্রাইক প্রান্ত থেকে দৌড়ে ওপাশে পৌঁছে যাবার আশা ছিল জাকের আলীর, কিন্তু টম ল্যাথামের থ্রো স্টাম্পের সঙ্গে ভেঙে দেয় তার স্বপ্নও।৫৫ বলে ৪৫ রানের ইনিংস খেলে রান-আউটে বিদায় তার। এরপর পেসাররা কিছু এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়েছেন, তাসকিন উড়িয়ে একটা চার মেরে একই পন্থা ফের অবলম্বন করতে গিয়ে দিয়েছেন ক্যাচ।নাহিদ রানা ব্যাটিংয়ে নেমে কাইল জেমিসনের করা শেষ ওভারের টানা ৪টা বল খেলেছেন, কিন্তু কোনো রান নিতে পারেননি। এভাবেই অলআউট না হওয়ার তৃপ্তি নিয়ে, ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ২৩৬ রানে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস। ২৬ রানে ৪ উইকেট ব্রেসওয়েলের, আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের কোনো স্পিনারের সেরা বোলিং। তারে ৬০টা ডেলিভারির ভেতর ৪৩টা ডেলিভারিতেই কোনো রান নিতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। অবশ্য গোটা ইনিংস জুড়েই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, ৩০০ বলের ইনিংসে ১৭৮টা বল ‘ডট’ খেলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা।

রাওয়ালপিন্ডির পাটা উইকেটে ২৩৬ রানের মামুলি পুঁজি বাঁচাতে হলে অবিশ্বাস্য বোলিংই করতে হতো বাংলাদেশকে। নতুন বলে খানিকটা অঘটনের আশঙ্কা জাগিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ ও নাহিদ রানা। ইনিংসের প্রথম ওভারেই, নিউজিল্যান্ডের স্কোরবোর্ডে কোনো রান যোগ হবার আগেই তাসকিন আহমেদের বলে ভাঙে উইল ইয়ং-এর স্টাম্প। ০ রানে আউট হন কিউই ওপেনার।ম্যাচের চতুর্থ ওভারে কেন উইলিয়ামসনকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন নাহিদ রানা। যে কোনো বড় আসরে এই তরুণ পেসারের প্রথম উইকেটটাই ছিল কিউইদের সেরা ব্যাটসম্যানের। এরপর ডেভন কনওয়ে (৩০) আর রাচিন রবীন্দ্র মিলে তৃতীয় উইকেটে ৫৭ রানের জুটি গড়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। মোস্তাফিজুর রহমানের বলে ইনসাইড এজ হয়ে কনওয়ে বোল্ড হলে খানিকটা আশার আলো দেখে বাংলাদেশ। কিন্তু সেই আশার মোমবাতি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছেন রাচিন রবীন্দ্র,সঙ্গে ছিলেন টম ল্যাথাম। বাংলাদেশকে পেলেই যার ব্যাটটা চওড়া হয়, তিন সংস্করণ মিলিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার ৫ খানা সেঞ্চুরি আর ৭ হাফসেঞ্চুরি। আর রাচিনের তো আইসিসি আসরে সেঞ্চুরি করাটা রীতিমতো অভ্যাস। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সোমবার চতুর্থ সেঞ্চুরি করলেন, তার আগের ৩ সেঞ্চুরি ছিল ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। এই দুই বাঁহাতি ব্যাটারকে যতক্ষণে বিচ্ছিন্ন করা গেল,ততক্ষণে ম্যাচের ভাগ্য সুনিশ্চিত। রিশাদ হোসেনের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে লংঅনে বদলী ফিল্ডার পারভেজ হোসেন ইমনের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছেন রাচিন, তার আগে মেরেছেন ১ ডজন বাউন্ডারি আর ১ ছক্কা। ল্যাথামের সঙ্গে চতুর্থ উইকেট জুটিতে ১২৯ রান যোগ করেছেন। এই জুটির কাছেই মূলত হার মেনেছে বাংলাদেশের বোলিং। দলকে জয়ের আরো কাছে নিয়ে যাবার পর মাহমুদউল্লাহ’র সরাসরি থ্রো-তে রানআউট হয়ে যান ৭৬ বলে ৫৫ রান করা ল্যাথাম। বাকি কাজটা সেরেছেন গ্লেন ফিলিপস আর ব্রেসওয়েল মিলে। তাসকিনের বলে পুল শটে বাউন্ডারি মেরে দুই দলের রান সমান করেন ফিলিপস, রিশাদের বলে চার মেরে শেষ করলেন সেই ব্রেসওয়েল, ম্যাচের প্রথম ইনিংসে বল হাতে ৪ উইকেট নিয়ে যে মানুষটি ধ্বসিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটিং। ৪ উইকেট নেয়া ব্রেসওয়েলের চারে জিতলো নিউজিল্যান্ড , ১ বল কম ৪ ওভার হাতে রেখে। নিয়তি বোধহয় এমনটাই লিখে রেখেছিল।

 

পূর্বের খবরইন্টারনেট শাটডাউন চিরতরে বন্ধে স্টারলিংককে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে: প্রেস সচিব
পরবর্তি খবরমেহজাবীন-রাজীবের বিয়ে নিয়ে যা বললেন জয়