আজ কমরেড মণি সিংহের প্রয়াণ দিবস। তাঁর জন্ম ১৯০১ সালে, মৃত্যু ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রথমদিকে তিনি বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবপন্থি দল ‘অনুশীলন’-এর সদস্য ছিলেন। পরে মস্কো থেকে আসা কমিউনিস্ট নেতার কাছে কমিউনিজমের দীক্ষা নেন; যুক্ত হন কলকাতায় মেটিয়াবুরুজের শ্রমিক আন্দোলনে। সেখানে এক আন্দোলনের সময় তিনি মালিকদের প্রতিনিধি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে এক শ্রমিক সমাবেশে তর্কে লিপ্ত হন। শ্রমিকদের পক্ষে তাঁর অকাট্য যুক্তি সবার প্রশংসা অর্জন করে।
মণি সিংহের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে গেলে তাঁর কাছে কৃষকরা তাদেরকে জমিদারের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার আবেদন জানান। তিনি কলকাতার শ্রমিক আন্দোলনে তাঁর জড়িত থাকার কথা জানান। অসহায় কৃষকদের পীড়াপীড়িতে মণি সিংহ চিন্তায় পড়ে যান। তখন ওই এলাকার কৃষকরা টঙ্ক প্রথার অত্যাচারে জর্জরিত। ফসল যেমনই হোক, খাজনা পুরো দিতে হবে– এই ছিল টঙ্ক প্রথা। আবার স্থানীয় জমিদার ছিলেন তাঁর মায়ের আত্মীয়। এ কারণেই কি জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে চাচ্ছেন না– নিজেকে প্রশ্ন করেন তিনি।
মণি সিংহ শপথ নিলেন– নিজের শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করবেন, তিনি সত্যিকার অর্থেই শ্রেণিচ্যুত, মেহনতিদের বন্ধু। শুরু হলো সংগঠন ও সংগ্রাম। আন্দোলন এক পর্যায়ে সশস্ত্র রূপ নিল। হাজং, গারো প্রভৃতি আদিবাসীর সঙ্গে বাঙালি মিলে তীর-ধনুক নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর রাইফেল মোকাবিলা করল। অনেকে শহীদ হলো, আহত হলো,
গ্রেপ্তার হলো। মণি সিংহসহ অনেকের নামে হুলিয়া জারি হলো।
একই সময় রাজশাহীতে রমেন মিত্র ও ইলা মিত্র, পাবনায় অমূল্য লাহিড়ী, রংপুরে মণিকৃষ্ণ সেন ও সয়েরউদ্দীন এবং সিলেটে বারীন দত্তের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রেই তা সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়। ১৯৪৬ সালে নেত্রকোনায় মণি সিংহের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় কিষান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ভারতবর্ষ থেকে কৃষক নেতারা সমবেত হন। ভারতের সিপিএমের একসময়কার সাধারণ সম্পাদক সুরজিত সিংহও ছিলেন সেখানে। অনেক বছর পরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা পূর্ব বাংলার দিকেই বিপ্লবের আশায় তাকিয়ে ছিলাম। এখনও তেমনি আশা করছি।’
ভারত বিভক্ত হওয়ার পর সব ওলটপালট হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, দেশত্যাগী হলো। তবে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক পরিবেশে এক বিরাট পরিবর্তন আনে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এক ক্রান্তিকাল। এই আন্দোলনের মূল কারিগর ছিলেন কমিউনিস্টরা। এভাবে মণি সিংহ ধাপে ধাপে দেশের আন্দোলন ও গণচেতনাকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নেন। ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর ব্যাপক গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯৬১ সালে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কাকরাইলের বাসায় শেখ মুজিব, মণি সিংহ, খোকা রায় ও বারীন দত্তের এক গোপন সভা হয়। আমি বঙ্গবন্ধু ও কমরেড মণি সিংহের কাছে এই গল্প অনেকবার শুনেছি। সেখানে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেখ ফজলুল হক মনি ও মোহাম্মদ ফরহাদকে ওই দুই সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সভায় শেখ মুজিব মণি সিংহকে বলেন, ‘দাদা, আমি কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন করব।’ মণি সিংহ বলেন, ‘এখনই এই কথা বললে বায়াফ্রার মতো আপনাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে অভিযুক্ত করবে। এখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন, তারপর পাকিস্তান সরকারের ভুল পরিস্থিতিকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নেবেন।’ শেখ মুজিব বললেন, ‘দাদা, আমি আপনার কথা গ্রহণ করলাম না, তবে জেনে নিলাম।’
এর পর ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে ৬ দফা উত্থাপন করেন। এতে শ্রমিক, কৃষকদের দাবি যুক্ত হলে কমিউনিস্ট ও ন্যাপ মোজাফফর এই আন্দোলনকে সমর্থন করে। এর পর আন্দোলন আরও বেগবান হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি উত্থাপনের পর। এই পথ বেয়ে সংঘটিত হয় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ভুল করেছে। মণি সিংহ এবং আরও অনেকে মুজিব সরকারের ভালো কাজকে সমর্থন এবং খারাপ কাজের বিরোধিতা করতে বলেন। কিন্তু ফরহাদ ও অনিল মুখার্জি রাজি হননি। শেখ মুজিব যখন বাকশাল করেন, তখনও মণি সিংহসহ অনেকেই বিরোধিতা করেন; তৎকালীন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি এ পরামর্শ দিয়েছিল। বাকশালের পরিণতি কী ভয়াবহ হলো, তা সবাই জানেন। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান ও মার্কিনপন্থিরা ক্ষমতায় এলো।
কমরেড মণি সিংহ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বলেছিলেন, বাম বিচ্যুত হলে পার্টি ভেঙে যায়। কিন্তু ডান বিচ্যুত হলে দল ঘুণে ধরা কাঠামোর মতো ঝুরঝুর করে পড়ে যায়। তাই হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির, ১৯৯০ সালে। বেশির ভাগ নেতা পার্টি বিলোপ করেছিল। আমি বিলোপবাদীদের প্রতিবাদে আগেই পদত্যাগ করেছিলাম এবং বাইরে থেকে সংগ্রাম চালাচ্ছিলাম। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির ১১ জন পার্টির স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করে।
পার্টির মধ্যে ফরহাদ ও অনিল মুখার্জিরা প্রচার করতেন, মণিদার তত্ত্বজ্ঞান তেমন ছিল না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থেকে দেখেছি, প্রতিটি ব্যাপারেই তিনি সঠিক প্রমাণিত হয়েছেন। সুতীক্ষ্ণ ছিল তাঁর দূরদৃষ্টি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ইরাকের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন কথায় কথায় আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা আর মণি সিংহ আমাদের জাতির দাদা।’
কমরেড মণি সিংহ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কমরেড মণি সিংহ, লাল সালাম।
মন্জুরুল আহসান খান: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি