ভাষা আন্দোলন আমাদের আত্মপরিচয়ের অংশ

 

আদিত্য শুদ্র

ভাষা কেবল একটি যোগাযোগের মাধ্যম নহে; ইহা একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তার বাহক। ভাষার মাধ্যমে মানুষ তাহার আবেগ, চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটাইয়া থাকে। প্রত্যেক মানুষের নিকট তাহার মাতৃভাষাই সবচাইতে প্রিয় ও সুমধুর। বিশ্বের ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম-যাহা প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইহা কেবল ভাষা নহে, ইহা আমাদের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিয়াছেন, ‘ভাষা হইল হৃদয়ের অভিব্যক্তি।’ এই ভাষাই আমাদের জাতীয় আন্দোলনের মূল প্রেরণা জুগাইয়াছে, জাতি হিসাবে আমাদের স্বকীয়তা নিশ্চিত করিয়াছে।

বিশ্বে প্রায় ৭ হাজার ভাষা রহিয়াছে, কিন্তু ইহার মধ্যে অনেক ভাষাই ধীরে ধীরে হারাইয়া যাইতেছে। ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, পরবর্তী এক শত বৎসরের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ভাষা বিলুপ্ত হইবে। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে মনীষীরা বলিয়া থাকেন-একজন মানুষ তাহার মাতৃভাষায় যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করিতে পারে, অন্য কোনো ভাষায় তাহা সম্ভব নহে। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার টিকিয়া থাকাই কেবল নহে, তাহার সমৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য। বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মাতৃভাষা হইলেও, আধুনিক বিশ্বের ভাষাগত প্রতিযোগিতায় ইহার অবস্থান সুসংহত করিবার জন্য আমাদের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করিতে হইবে। এক জরিপে বলা হইয়াছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে চাইনিজ, স্প্যানিশ ও ইংরেজি সবচাইতে প্রভাবশালী ভাষা হইবে।

তথাপি প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ভাষান্তরের প্রক্রিয়া আরো সহজ ও গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠিবে। কিন্তু মাতৃভাষার গুরুত্ব কেবল যোগাযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে; ইহা একটি জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। ফ্রিডরিখ শিলার বলিয়াছেন, ‘যে জাতি তাহার ভাষা রক্ষা করিতে পারে না, সে জাতি আপন সত্তা সংরক্ষণ করিতেও ব্যর্থ হয়।’ বাংলা ভাষার গৌরবময় ইতিহাস আমাদের স্মরণ করায়, কীভাবে ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করিবার ঘটনা একমাত্র এই ভাষারই বৈশিষ্ট্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই মূলত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাহাদের জাতিগত স্বতন্ত্রতা রক্ষা করিবার আন্দোলন শুরু করিয়াছিল। এই ভাষার জন্য সংগ্রামই ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার মূল প্রেরণা হইয়াছিল। বিশ্বে মাতৃভাষার অধিকারের জন্য আত্মত্যাগের এমন উদাহরণ বিরল। এই কারণে ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃত। নেলসন ম্যান্ডেলা বলিয়াছেন, ‘যদি তুমি মানুষের সঙ্গে তাহার বুঝিতে পারা ভাষায় কথা বল, তবে তাহা তাহার মাথায় প্রবেশ করে; কিন্তু যদি তাহার মাতৃভাষায় কথা বল, তবে তাহা তাহার হৃদয়ে প্রবেশ করে।’

আমাদের ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাহার চর্চা, সংরক্ষণ ও বিকাশের উপর। প্রযুক্তির প্রসার ও বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষা শিক্ষা করিবার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবে তাহা মাতৃভাষার ক্ষতির কারণ হইতে পারে না। ভাষাবিদ নোম চমস্কি বলিয়াছেন, ‘একটি ভাষার মৃত্যু মানেই একটি সংস্কৃতির মৃত্যু’। সুতরাং, আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। তাহা ছাড়া, বাংলা ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নহে; ইহা আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক, আমাদের অহংকার। একুশের চেতনা আমাদের শিখাইয়াছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে, তাহার মাধ্যমে আমরা আত্মপরিচয়ের সন্ধান পাইয়াছি। এখন সময় আসিয়াছে বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করিবার, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করিয়া তুলিবার।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলা কেবল একটি ভাষা নহে, ইহা আমাদের স্বপ্ন, আমাদের আবেগ, আমাদের ইতিহাস। এই ভাষার প্রতি ভালোবাসাই আমাদের জাতিগত ঐক্য ও আত্মপরিচয়ের মূল শক্তি। তাহার জন্য চাই আরো সচেতনতা, আরো যত্ন, আরো গবেষণা। তাহার মাধ্যমেই বাংলা ভাষা চিরঞ্জীব থাকিবে, যুগ যুগ ধরিয়া বিশ্বের দরবারে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।

পূর্বের খবরহোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা আশা করছেন ইউক্রেন খনিজ
পরবর্তি খবরনারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসী হামলার শিকার দিতি–সোহেল চৌধুরীর মেয়ে লামিয়া