ভিনিউজ ডেস্ক : অ্যামেরিকার উপর নির্ভরতা কমিয়ে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন বাড়াতে তুরস্কের সঙ্গে কাজ করতে চায় ইউরোপ। কিন্তু তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে এখন ইউরোপ এ নিয়ে পড়েছে দ্বন্দ্বের মধ্যে।
ইস্তাম্বুলের মেয়রকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
তুরস্ক-ইইউ সম্পর্ক ২০২৫ সাল থেকে অন্য সময়ের চেয়ে স্বাভাবিক হলেও এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ আবার এটিকে জটিল করে তুলছে।
একদিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং অন্যদিকে আঞ্চলিক স্বার্থ, এই দুইয়ের মধ্যে পরিস্থিতির সতর্ক পর্যবেক্ষণের অবস্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তুরস্কের সম্পর্কের অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে জটিল পরিস্থিতিতে রয়েছে। আঙ্কারা এখনো কাগজে-কলমে ইইউ জোটের সদস্যপদ প্রার্থী। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মিত্র হিসাবে বেশিরভাগ ইইউ রাষ্ট্র এবং তুরস্ক বহিঃশত্রুর আক্রমণের ক্ষেত্রে একে অপরকে রক্ষা করায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের ক্ষতি করা এবং ইইউতে তুরস্কের সদস্যপদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় ‘স্থবিরতা’ সৃষ্টি করার অভিযোগ করেছে ইইউ। চলতি সপ্তাহে তুরস্কে এর্দোয়ানের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করার ঘটনাটিকে অ্যামনেস্টি “শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর নিরাপত্তা বাহিনীর অপ্রয়োজনীয় এবং নির্বিচার বলপ্রয়োগ” বলে অভিহিত করেছে। তবে এই ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই নরম বলে মনে করছেন অনেকে।
এর সম্ভাব্য কারণ, ইউরোপের জন্য বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট আগের চেয়ে আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে ইউরোপ
তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দাবি এই বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে এবং এটি একটি ‘সহিংস আন্দোলন’। তবে ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু এবং ‘অন্যান্য অনেক’ ব্যক্তির কারাদণ্ডকে ‘গণতন্ত্রের উপর গুরুতর আক্রমণ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
জার্মানির বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক সতর্ক করে বলেছেন, “রাজনৈতিক বিরোধীদের স্থান জেল বা আদালত হতে পারে না।” কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্র ব্রাসেলস বেশ সাবধানতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র গিওম ম্যার্সি সাংবাদিকদের বলেছেন, “মেয়র একরেম ইমামোলু এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার তুরস্কের দীর্ঘস্থায়ী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয়।” তিনি যোগ করেন, “তুরস্ককে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে হবে।”
আগামী মাসেই তুর্কি কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক অংশীদারত্বের আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এটা বাতিল বা পেছানো হবে কিনা জানতে চাইলে ম্যার্সি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
সায়েন্সেস পো গ্রেনোবলের ইইউ-তুরস্ক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জিন মার্কো ডয়চে ভেলেকে বলেন, “তুরস্কে যা ঘটছে, তার গুরুত্ব এবং ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়ার তীব্রতার মধ্যে কিছুটা বৈপরীত্য রয়েছে।”
সাবেক এই ফরাসি কূটনীতিক বলেন, “ইউরোপীয় অংশীদাররা প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় নিয়েছে।”
ইইউর দৃষ্টিতে তুরস্কের সামরিক শক্তি
ইউরোপীয় পলিসি সেন্টারের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক আমান্ডা পল মনে করেন, এর একটি স্পষ্ট কারণ রয়েছে।
ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, “সম্ভবত আমরা সকলেই যে নতুন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাস করছি, এটা তারই প্রতিফলন।”
হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমন ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ইস্যুকে সামগ্রিক পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে। ইইউভুক্ত রাষ্ট্রগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ওয়াশিংটনের সুরক্ষা ছাড়াই ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নেয়ার পরিকল্পনা করছে।
ন্যাটো প্রতিরক্ষা জোটে তুরস্কের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। পল মনে করেন, ইউরোপীয় ও এশীয় মহাদেশ জুড়ে দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান কৃষ্ণ সাগরের ওপারে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মুখোমুখি হওয়ায় তুরস্ক এমন একটি “ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছে, যা এই অঞ্চলের, এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের নেই।”
তুরস্কের ক্রমবর্ধমান অস্ত্র শিল্পের দিকেও নজর রয়েছে ইইউ এর। নিজেদের জাতীয় সামরিক বাহিনীর জন্য আরও বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজছে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো।
পল বলেন, “যখন অস্ত্রের উল্লেখযোগ্য ঘাটতি রয়েছে, তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পের তখন ইইউকে দেওয়ার জন্য অনেক কিছু রয়েছে।”
বাইরে শক্তিশালী, ভেতরে ভঙ্গুর?
সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে চুপ করিয়ে দেওয়ার অভিযোগে বিশ্বব্যাপী শিরোনামে আসার আগে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান ২০২৫ সাল কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ ভালো সময়ই কাটাচ্ছিলেন।
রাশিয়ার যুদ্ধের দ্রুত অবসান ঘটাতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর তথাকথিত ‘ইচ্ছুকদের জোট’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তুরস্ক। গত সপ্তাহে, ইইউর শীর্ষ নেতারা প্রতিরক্ষা বিষয়ে তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ আলোচনা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ফোন করেছিলেন এর্দোয়ানকে।
এবং এখানেই শেষ নয়। পল মনে করেন, তুরস্ক “তার প্রতিবেশী এবং তার বাইরেও বৈদেশিক নীতিতে বড় নিয়ামক হয়ে উঠেছে, তা সে সিরিয়া, দক্ষিণ ককেশাস বা মধ্য এশিয়াই হোক না কেন।”
তার মতে, “তিনি (এর্দোয়ান) মনে করেন যে, তিনি এই মুহূর্তে ইউরোপের প্রায় একজন অপরিহার্য অংশীদার। এই ধারণা তাকে অভ্যন্তরীণভাবে এই পদক্ষেপ (বিরোধীদের দমন) নেওয়ার জন্য আরো আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।”
ইমামোলুর গ্রেপ্তার রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এমন অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন এর্দোয়ান।
অন্যান্য দেশেও চাপের মুখে গণতন্ত্র
গবেষক জিন মার্কো মনে করেন, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতার দিকেও গভীর মনোযোগ দিচ্ছেন তুর্কি নেতা।
মার্কো বলেন, “কেন তিনি এটা করছেন? কারণ, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী, গণতন্ত্রের উপর একাধিক আক্রমণ হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোও।”
ট্রাম্পের সঙ্গে এর্দোয়ানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ইইউর নজরে রয়েছে।
মার্কোর মতে, “তুরস্ককে আকৃষ্ট করার জন্য ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা চলছে। আমার মনে হয় ইউরোপীয়রা সম্ভবত তুরস্ককে হারাতে চায় না এবং আমি মনে করি এরদোগানও এটি খুব ভালো করেই জানেন।”
মূল্যবোধ বনাম জরুরি স্বার্থ
তবে তুরস্কের ইউরোপীয় অংশীদারদের উপর প্রতিক্রিয়া জানানোর চাপও বাড়বে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শহরগুলোর মেয়ররা স্ট্রাসবুর্গে জড়ো হন। তারা ইস্তাম্বুলের মেয়রের বিরুদ্ধে “বিচারিক হয়রানির” নিন্দা জানাবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচিত আইনপ্রণেতারাও সম্ভবত ইইউ এবং জাতীয় সরকারগুলোকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাবেন।
মার্কো মনে করেন, “(তুরস্কে) আরও কঠোর দমন-পীড়ন হলে কী হবে? সম্ভবত এমন ঘটনা ইউরোপীয়দের আরও সোচ্চার হতে বাধ্য করবে।”
“কিন্তু শেষ পর্যন্ত,” তিনি মনে করেন, “তারা তাদের মূল্যবোধ এবং তাদের কৌশলগত স্বার্থের মধ্যে দ্বিধায় পড়বে।”