ভিনিউজ ডেস্ক : ২৩ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ নিজ ইশতেহার ঘোষণা করছে জার্মানির রাজনৈতিক দলগুলো৷ অভিবাসন বিষয়ে কী থাকছে তাদের ইশতেহারে? এবার থাকছে জার্মানির ডানপন্থি দল সিডিইউ/সিএসইউর ইশতেহারের বিশ্লেষণ৷
আসন্ন নির্বাচনে অভিবাসনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখছেন জার্মানির অনেক ভোটার৷ চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশিত এক জরিপে সেটাই উঠে এসেছে৷ অর্থনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সংঘাতকে ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে অভিবাসন (৩৭ শতাংশ) রয়েছে শীর্ষে৷
জার্মানির ভেতরে কিংবা বাইরের ঘটনাপ্রবাহ বিষয়টিকে আরও তীব্র করে তুলেছে৷ ২০২৪ সালে ছুরি দিয়ে আক্রমণের বেশ কয়েকটি ঘটনায় জড়িত ছিল অভিবাসীরা৷ এমনকি মাগডেবুর্গ শহরের ক্রিসমাস মার্কেটে ভয়াবহ হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিটিও ছিল জার্মানিতে শরণার্থী মর্যাদা পাওয়া একজন৷ এসব ঘটনার জের ধরে অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর হওয়া এবং কঠোর নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন অনেক জার্মান নাগরিক৷ ভোটারদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোও৷ নিজেদের অভিবাসন নীতিকে কঠোর করেছে তারা৷
সিরিয়ার স্বৈরশাসক আসাদের পতন অভিবাসন এবং আশ্রয় বিষয়ক বিতর্ককে আরো উসকে দিয়েছে৷ কারণ ইউরোপে আসা সিরিয়ান শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের মোট সংখ্যার বড় অংশটিই থাকেন জার্মানিতে৷ আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ানরা এখন নিজ দেশে ফিরে যাবে কিনা এবং তাদের ফিরে যাওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে রাজনীতিবিদ এবং ভোটারদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে৷
খ্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস (সিডিইউ) এবং তাদের বাভারিয়ান সহযোগী দল সিএসইউ এক হয়েই সিডিইউ/সিএসইউ হয়েছে৷‘অভিবাসন নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন’এর মধ্য দিয়ে তারা অ্যাঙ্গেলা মের্কেল যুগের চূড়ান্ত অবসান চায়৷ ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মের্কেল৷ আশ্রয় ইস্যুতে তার উদার নীতির কারণে ২০১৫ সাল এবং পরবর্তী বছরগুলো মিলিয়ে ১৩ লাখ আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপীয় ইউনিয়নে পৌঁছেছেন৷
ওই সময় প্রসঙ্গে সিডিইউ/সিএসইউ নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস বলেছেন, ‘‘আমরা সরকারে থাকার সময় ভুল করেছি এবং সেখান থেকে শিখেছি৷”
ডানপন্থিদের আরো কঠোর অবস্থান
রাজ্য নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থি দল এএফডি (অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি) এর সাম্প্রতিক সাফল্যে জার্মান রাজনীতির মধ্য-ডানপন্থি সিডিইউ/সিএসইউ-এর ঐতিহ্যগত স্থিতিশীল অবস্থান কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে৷
এএফডি এর সাফল্যের কারণে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সিডিইউ/সিএসইউকে অভিবাসন ইস্যুতে আরো কঠোর অবস্থান নিতে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
বর্তমান জরিপে শীর্ষে থাকা সিডিইউ/সিএসইউ জোট সরকার গঠনে এগিয়ে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ তাই অভিবাসন ইস্যুতে তাদের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে সবারই আগ্রহ রয়েছে৷
৮২ পৃষ্ঠার নির্বাচনি ইশতেহারে, চলমান সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ‘অবিলম্বে অভিবাসন স্থগিত’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সিডিইউ/সিএসইউ৷
এই স্থগিতকরণের অর্থ হলো দেশটির নয়টি স্থল সীমান্ত দিয়ে অনিয়মিতভাবে জার্মানিতে ঢোকার চেষ্টাকারী এবং আশ্রয়প্রত্যাশীদের প্রত্যাখ্যান করা৷
তবে, জার্মানি তার ‘মানবিক দায়িত্ব’ পালন অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে দলটি৷ সুরক্ষার প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের সুরক্ষা এবং বাসস্থানের ব্যবস্থাও করবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করেছে দলটি৷
দলটি জার্মানিতে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যার একটি সীমা বেঁধে দিতে চায়৷তবে সেটা বিদেশি দক্ষ কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না৷
‘অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধে’ রক্ষণশীল দলটি মনে করে, জার্মানির জাতীয় আশ্রয় ব্যবস্থায় ‘‘দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ, নিরাপদ শনাক্তকরণ এবং আশ্রয় বিষয়ক সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা” ধরে রাখা প্রয়োজন৷
সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আমলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েনস স্পানের মতো কয়েকজন নেতা বলছেন, যারা ‘নিরাপদ তৃতীয় দেশ’ পেরিয়ে জার্মানিতে পৌঁছেছেন (যাদের বেশিরভাগ স্থলপথ দিয়ে আসেন) সীমান্তেই তাদের আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করে ফেরত পাঠানো উচিত৷
ফিনল্যান্ড এবং আরো কয়েকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের মতো জার্মানিও যদি সীমান্তে আশ্রয় আবেদনের অধিকার স্থগিত করে, তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হতে পারে৷ কারণ, জার্মানির সংবিধানে আশ্রয়ের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত৷
সহায়ক সুরক্ষাপ্রাপ্তদের পারিবারিক পুনর্মিলনেরক্ষেত্রেও স্থগিতাদেশ আরোপ করতে চায় সিডিইউ/সিএসইউ৷
জার্মানিতে সহায়ক সুরক্ষা হলো আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষার একটি কাঠামো, যার মাধ্যমে আশ্রয় বা শরণার্থী মর্যাদার অধিকারী হিসাবে স্বীকৃত নয় এমন ব্যক্তিদের বিশেষ বিবেচনায় আশ্রয় দেয়া হয়৷
সিডিইউ-এর শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ ইয়েনস স্পান জার্মান ব্রডকাস্টার রিডাকৎশিয়ন নেটৎসভের্ক ডয়েচলান্ড (আরএনডি)-কে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন পারিবারিক পুনর্মিলন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা উচিত৷ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সমাজ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে৷”
এরপর, তার কাছে আরো জানতে চাওয়া হয় সব ধরনের পারিবারিক পুনর্মিলন প্রক্রিয়া তিনি বন্ধ করতে চান কি-না৷ উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘একেবারে, সম্পূর্ণভাবে৷”
আরএনডি জানিয়েছে, ২০২৩ সালে জার্মানি এক লাখ ৩০ হাজার পারিবারিক পুনর্মিলন ভিসা ইস্যু করেছে৷ এসব ভিসার বেশিরভাগই পেয়েছেন সিরিয়া, তুরস্ক এবং ভারতের নাগরিকেরা৷ জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অবশ্য এখনও পাওয়া যায়নি৷
ইশতেহার অনুযায়ী, কয়েক দশক ধরে চলতে থাকাস্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন কর্মসূচিও বন্ধ করতে চায় রক্ষণশীল এই রাজনৈতিক দলটি৷
দ্রুততর আশ্রয় প্রক্রিয়া, বেশিসংখ্যক প্রত্যাবাসন
আশ্রয় প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করা এবং বেশিসংখ্যক প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে বেশিসংখ্যক দেশকে ‘নিরাপদ দেশ’ ঘোষণা করার পরিকল্পনাও নিয়েছে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলটি৷ যেসব দেশ থেকে বেশিসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী আসেন সেসব দেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি করারও পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে দলটি৷
যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাদের জন্য সামাজিক সুবিধার মাত্রাকে ‘বিছানা, রুটি এবং সাবান’ নীতিতে সীমিত করতে অর্থাৎ ন্যূনতম সুবিধা দিতে চায় দলটি৷ এছাড়াও আশ্রয়প্রার্থীদের নগদ অর্থের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করার প্রস্তাবকেও সমর্থন দিচ্ছে রক্ষণশীল দলটি৷
দোষী সাব্যস্ত অপরাধী এবং বিশেষ করে বিপজ্জনক হিসাবে বিবেচিত আফগান ও সিরিয়ান আশ্রয়প্রার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চায় দলটি৷
তিন বছরের বিরতির পর গত আগস্ট থেকে জার্মানিতে গুরুতর অপরাধে জড়িত অভিবাসীদের তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো শুরু হয়েছে৷ বিদায়ী সরকার আরো প্রত্যাবাসনের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে৷
নগদ অর্থের বদলে পেমেন্ট কার্ড
জার্মানিতে অবস্থানরত আশ্রয়প্রার্থীদের নগদ অর্থের বদলে বর্তমানে দেয়া হচ্ছে পেমেন্ট কার্ড৷ জার্মানির ১৬টি রাজ্যে এই ব্যবস্থাটি চালু হতে যাচ্ছে৷ আশ্রয়প্রার্থীদের সবার জন্য এই কার্ড নিশ্চিত করতে চায় সিডিইউ/সিএসইউ৷ তাতে নগদ অর্থ নিজ দেশে পাঠানো বন্ধ হবে বলে মনে করছে দলটি৷
ইউক্রেন থেকে আসা নতুন শরণার্থীদের শুধু আইন অনুযায়ী সেবা পাওয়া উচিত বলেও মনে করে দলটি৷ তাদের আশা, এসব আশ্রয়প্রার্থীরা দ্রুততম সময়ে একটি কাজের ব্যবস্থা করে নেবেন৷
দোষী সাব্যস্ত হলে নাগরিকত্ব বাতিল
গত বছর কার্যকর হওয়া জার্মান নাগরিকত্ব আইনের কিছু অংশ বাতিল করতে চায় সিডিইউ/সিএসইউ৷
রাজনৈতিক দলটির লক্ষ্য হলো ‘চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আইন’ প্রবর্তন করা৷ এই আইনের আওতায় ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের লক্ষ্য এবং কর্মকাণ্ড প্রচারে’ যুক্ত এবং আইনের চোখে দোষী সাব্যস্তদের মধ্যে যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে তাদের জার্মান পাসপোর্ট বাতিল করা হবে৷
দলটির চ্যান্সেলর প্রার্থী ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা সব দোষী সাব্যস্ত অপরাধীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে৷
ম্যার্ৎসের এমন বক্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক৷ তারা বলছেন, ভোটারদের মন জয় করতে বৈষম্যমূলক বক্তব্য এবং অতি-ডানপন্থি নীতি গ্রহণ করছেন ম্যার্ৎস৷