দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে প্রথম এলেন সিডিইউ নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস। তাকে প্রশ্ন করা হলো, জার্মানদের কতটা আর্থিক বোঝা বহন করতে হবে?
সিডিইউ নেতার জবাব, ”সিডিইউ এজেন্ডা ২০৩০ নিয়ে চলছে। সেখানে বলা হয়েছে, যারা কাজ করতে চাইবেন না, তাদের জনগণের অর্থ থেকে চলা জনকল্যাণকর প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে কড়া মনোভাব দেখানো হবে। আর যারা কঠোর পরিশ্রম করেন, যাদের উপর করের বোঝা বেশি, তাদের সুবিধা দেয়া হবে।”
কৃষি নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ”জার্মানি যদি সিও২ নিঃসরণ কমাতে চায়, তাহলে আর নিয়মকানুনের দরকার নেই, সমাধানের পথ দেখানো দরকার।”
অভিবাসন ও অপরাধ সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে ম্যার্ৎস বলেন, ”অবৈধ অভিবাসীদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। তারা যে অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত তা অস্বীকার করা যায় না।”
ম্যার্ৎসের সঙ্গে হাত মেলানোর পর তিনি এই বিষয়ে একমত হন যে, ২৩ ফেব্রুয়ারির পর যে সরকার গঠিত হবে, তাতে তারা দুইজনে একসঙ্গে থাকবেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটের পর সিডিইউ এবং এসপিডি-র জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা খুবই প্রবল।
শলৎসকে প্রশ্ন করা হয়, কী করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবে জার্মানি? শলৎস বলেছেন, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাটা খুবই জরুরি। একইসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স জার্মানির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন।
জার্মানির নির্বাচন আসন্ন। চ্যান্সেলর-পদপ্রার্থী চার নেতা টিভি বিতর্কে অংশ নিলেন। কী বললেন তারা?
কী বলছে সমীক্ষা?
সমীক্ষা বলছে রক্ষণশীল সিডিইউ ৩০ শতাংশ, অতি ডানপন্থি এএফডি ২০ শতাংশ, বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের এসপিডি ১৫ শতাংশ এবং গ্রিন পার্টি ১৩ শতাংশ ভোট পেতে পারে। এই চার প্রধান দলের চ্যান্সেলর পদপ্রার্থীরা যোগ দিয়েছিলেন টিভি বিতর্কে।
সিডিইউ নেতা যা বললেন
সিডিইউ নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস বলেছেন, ”নির্বাচনের পর আমাদের বেশ কয়েকটা সমস্যার সমাধান করতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে অবৈধ অভিবাসন এবং অর্থিক বৃদ্ধি থমকে যাওয়ার সমস্যা। আমি এমন সরকার গঠন করতে চাই, যারা নিজেদের মধ্যে বিরোধে কালক্ষেপ করবে না, যারা ইউরোপে গুরুত্ব পাবে। আমরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী হলেই তা সম্ভব। ভালো শিক্ষানীতি, তরুণ উদ্যোগপতিদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করে এটা করা সম্ভব।”
‘এএফডি-র সঙ্গে হাত মেলাব না’
ম্যার্ৎস বলেছেন, তিনি অতি ডানপন্থি এএফডির সঙ্গে কখনোই সরকার গঠনের জন্য হাত মেলাবেন না। তাহলে কার সঙ্গে তিনি হাত মেলাতে পারেন? সিডিইউ নেতার জবাব, ”সম্ভবত এসপিডি, সম্ভবত গ্রিনের সঙ্গে।”
ওলাফ শলৎসের বক্তব্য
বর্তমান চ্যান্সেলর এবং এসপিডি নেতা ওলাফ শলৎসের বক্তব্য, ”বিতর্ক থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে, বর্তমান চ্যান্সেলরের আবার ক্ষমতায় আসা উচিত। ইউরোপের সুরক্ষা, যুদ্ধ ও শান্তি এবং আর্থিক কারণে এসপিডি-কে মানুষের দরকার। তারা পেনশন কম করবে না, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোর উন্নতি করবে, বিনিয়োগ বাড়াবে, দেশকে এক করে রাখবে। তারা ন্যূনতম মজুরিও বাড়াবে।”
এএফডি নেত্রীর দাবি
অতি ডানপন্থি এএফডি নেত্রী অ্যালিস ভাইডেল বলেছেন, ”আমরা জার্মানিকে ধনী ও নিরাপদ করতে চাই। আমরা বেআইনি অভিবাসন থামাব। যারা অবৈধভাবে ঢুকেছে বা অপরাধ করছে, তাদের ফেরত পাঠাব। সিডিইউ এটা করতে দেয়নি। বিদ্যুৎক্ষেত্রে আমাদের মাসুল সবচেয়ে বেশি। আমরা নতুন প্রযুক্তি এনে তার বদল করব। আমরা দেশের করদাতাদের উপর বোঝা চাপাব না।”
গ্রিন পার্টি যা বলছে
গ্রিন পার্টির নেতা রবার্ট হাবেক বলেছেন, “আমার বয়স ৫৫ বছর। আমি এমন একটা দেশে বাস করেছি, যেখানে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই নিশ্চয়তা আর নেই। নির্বাচনের পর আমরা একযোগে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব। আমি সেই জার্মানির সেবা করতে চাই, যেখানে আমাদের সন্তানরা আপনার ছেলেমেয়েরা অতীতের মতো একইরকম সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতে থাকতে পারে।”
ইউক্রেন নিয়ে
এএফডি নেত্রী অ্যালিস ভেইডেল বাকি তিন দলের ইউক্রেন নীতির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, জার্মানির নিরপেক্ষ থাকা উচিত। কিন্তু ম্যার্ৎস জানিয়ে দেন, ”ইউক্রেন নিয়ে আমরা নিরপেক্ষ নই, আমরা ইউক্রেনের পক্ষে।” গ্রিন নেতা রবার্ট হাবেক জানান, ”এএফডি ছাড়া সব দলই ইউক্রেনকে সমর্থন করে।”
অর্থনীতি প্রসঙ্গে
এই বিতর্কে অর্থনীতি ও শক্তিক্ষেত্রে সংকট রীতিমতো গুরুত্ব পায়। সিডিইউ নেতা ম্যার্ৎস বলেন, জোট সরকার তিনটি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে সংকট ডেকে এনেছে। এএফডি নেত্রী ভাইডেল বলেছেন, তিনি নিরাপদ পরমাণু, কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের পক্ষে। পাশাপাশি নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে। হাবেকের দাবি, রাশিয়ার গ্যাস আসা বন্ধ হওয়া এবং রপ্তানি কমে যাওয়ার ফলে এই সংকট।
শলৎসকে প্রশ্ন করা হয়, জার্মানিতে তরুণ কর্মী কমছে, বয়স্কদের সংখ্যা বাড়ছে। এই সংকট কী করে সমাধান করবেন? শলৎস বলেছেন, ”কর্মীদের নিজেদের পছন্দমতো চাকরির ক্ষেত্র বাছাইয়ের স্বাধীনতা দেয়া হবে, কর্মসংস্থান আরো বাড়ানো হবে, বিদেশি দক্ষ শ্রমিকদের সুযোগ দেয়া হবে।”
বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাওয়া ও প্রবীণদের আর্থিক অসুবিধায় পড়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ”বাড়ি ভাড়ায় লাগাম পরাতে আইন করতে হবে। সকলের জন্য আবাসনের সুবিধা আরো বাড়ানো দরকার।” তিনি দাবি করেছেন, হাজার হাজার নতুন অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির জন্য জমি তার প্রশাসন তৈরি করে রেখেছে।
এএফডি নেত্রী অ্যালিস ভাইডেলের প্রশ্নোত্তর
এএফডি নেত্রীকে প্রথমেই এক ক্যাথলিক যাজক প্রশ্ন করেন, নার্সিংয়ের জন্য বিদেশিরা জার্মানিতে কাজের জন্য এলে তারা কি জার্মানিতে থাকতে পারবে? ভাইডেল বলেন, এএফডি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। তারা এটা মানেন, জার্মানির বৈধ অভিবাসীদের দরকার আছে।
বাইডেলের দাবি, আফগান, সিরীয়, ইরাকিদের মতো বিদেশিদের জন্য জার্মানিতে অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে।
একজন সমকামী ভাইডেলকে প্রশ্ন করেন, তিনি নিজে সমলিঙ্গের মধ্যে সম্পর্কে বিশ্বাস করেন, অথচ তার দল এটাকে মানে না, তাহলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কোথায় থাকলো? ভাইডেল এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলেন, তার দল সব তরুণ নাগরিকের সমান আর্থিক সুয়োগ চায়।
তাকে প্রশ্ন করা হয়, বাচ্চাদের সেল ফোন ব্যবহার করার জন্য একটা বয়স কি বেঁধে দেয়া উচিত? এএফডি নেত্রী বলেন, এক্ষেত্রে বাবা-মা-কে রোল মডেল হতে হবে। তবে স্কুলে সেলফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করাটা ভালো আইডিয়া বলে তিনি মনে করেন।
আসছে ২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে ২৯টি দলের প্রতীক থাকছে ভোটের ব্যালটে৷ যাদের বেশিরভাগই নির্বাচনে পর্যাপ্ত ভোট পেয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ ছবিঘরে থাকছে এমন কয়েকটি দলের কথা
টিয়ারশুটজ পার্টাই
জার্মানরা পোষা প্রাণী প্রচণ্ড ভালোবাসেন৷ আট কোটি ৮৪ লাখ বাসিন্দার দেশে পোষা প্রাণী রয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ৷ টিয়ারশুটজ পার্টাই বা দ্য হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট এনিম্যাল প্রোটেকশন পার্টি প্রাণির অধিকারও সংবিধানে যুক্ত করতে চায়৷ সবশেষ ২০২১ সালের নির্বাচনে তারা ১.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷ সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে অন্তত ৫ শতাংশ ভোটের দরকার হয়৷
ফ্রাই ভ্যাহলার (ফ্রি ভোটার্স)
মধ্য ডানপন্থি ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন বা সিডিইউ ও উগ্র ডানপন্থি অল্টারনাটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড বা এএফডির ঠিক মাঝামাঝি অবস্থান এই ফ্রাই ভ্যাহলার বা ফ্রি ভোটার্স দলটির৷ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে দক্ষিণ ও পূর্ব জার্মানিতে দুটি আসন জিতলেও তা প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যথেষ্ট ছিল না৷
ভল্ট
মধ্যপন্থি এই দলটি ২০১৭ সালে গঠিত হয়৷ ভল্ট এর মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রগতিশীলতা ও শক্তিশালী ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার আদর্শ৷ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনটি আসনের পাশাপশি ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ০.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল ভল্ট৷
ডি পার্টাই
কৌতুক ও স্যাটায়ারের জন্য বেশ বিখ্যাত ডি পার্টাই বা দ্য পার্টি৷ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বও করেছে কমেডিয়ান ও এডিটর মার্টিন জনেবর্ন এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি৷ ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১ শতাংশের চেয়ে কিছু কম ভোট পেয়েছিল৷
এসএসভে
এসএসভে (সাউথ স্লেষভিগ ভোটার্স এসোসিয়েশন) জার্মানির একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল৷ স্লেষভিগ হলস্টাইন রাজ্যে ডেনিশ ও ফ্রিজিয়ান সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে দলটি৷ ২০২১ সালে নির্বাচনের আগে ১৯৬১ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এসএসভে৷ মুক্ত বাজার অর্থনীতির পাশাপাশি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এসএসভে-র উদ্দেশ্য৷
পাইরেট পার্টি
সুইডেনের পাইরেট পার্টির অনুকরণে ২০০৬ সালে বার্লিনে গঠিত হয় পাইরেট পার্টি৷ ইন্টারনেট সিকিউরিটি, তথ্যের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা দলটির উদ্দেশ্য৷ ২০১৪ থেকে ২০২৪ এ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধিত্ব করলেও ২০২১ সালের সাধারণ নির্বাচনে মাত্র ০.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷
গ্রিন পার্টির নেতা রবার্ট হাবেকের বক্তব্য
গ্রিন পার্টির নেতা রবার্ট হাকেককে বিদ্যুতের বিল, বাড়ি বাড়া, দিনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রস্নের মুখে পড়তে হয়। তিনি বলেন, ইউক্রেন য়ুদ্ধের ফলে তা বেড়েছে। তার দাবি, আমলাতন্ত্রর প্রভাব কমাতে হবে এবং তিনি সেই কাজ শুরু করেছেন।
হাবেক বলেছেন, এসপিডি, গ্রিন ও এফজিপি জোটের আমলে সবচেয়ে বড় ভুল হলো, তারা দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোগত প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ করেনি।
নির্বাচনী প্রচারে কোন বিষয় সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাচ্ছে? হাবেক বলেন, পরিবেশই সবচেয়ে কম গুরুত্ব পাচ্ছে।