প্রশান্ত মহাসাগরের মানচিত্রে আঙুল রাখলেই চোখে পড়ে এক বিন্দুর মতো ছোট্ট দেশ—সামোয়া। গুগল ম্যাপের নীল জলরঙের মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে আছে দূরবর্তী সীমান্তে, সভ্যতার কোলাহল থেকে বহু দূরে। এখানে পৌঁছানো মানে কেবল একটি দেশ দেখা নয়—বরং সময়ের স্রোত উল্টিয়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ফিরে যাওয়া।
আমি যখন প্রথম সামোয়ার মাটিতে পা রাখি, হাতে ছিল আমার বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা, আর মনে ছিল অজানা এক উত্তেজনা। চারপাশে কেবল সমুদ্রের গর্জন, নারকেল গাছের ফিসফিসানি, আর হাসিমাখা স্থানীয়দের অভ্যর্থনা। শহরের ভিড় নেই, নেই অতিরিক্ত পর্যটনের অবিরাম হইচই—বরং আছে শান্তির ছোঁয়া, যা কেবল প্রকৃতি দিতে পারে।
এটাই আমার বিশ্বভ্রমণের ১৭৯তম দেশ। লাল-সবুজের পতাকা হাতে আমি এই দেশে প্রবেশ করলাম, আর প্রথম মুহূর্ত থেকেই অনুভব করলাম—এখানে কিছু ভিন্ন আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে চলা সামোয়ান সংস্কৃতি, তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, ফুলের ভাষা, আর প্রকৃতির সাথে গভীর সংযোগ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখানে প্রতিটি মানুষ যেন নিজের জীবনযাপনকে ধীর ছন্দে সাজিয়ে নিয়েছে—যেন সময়ের তাড়া নেই, শুধু মুহূর্তের সৌন্দর্য উপভোগ করার এক নীরব চুক্তি আছে প্রকৃতির সাথে। আহা কি অসাধারণ এই দেশ সামোয়া!

এই অভিযাত্রা আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। আমি হেঁটে গিয়েছি সবুজ গ্রামের সরু পথ ধরে, শুনেছি ঢেউয়ের মৃদু গান, দেখেছি সূর্যাস্তের সময় আকাশের রঙের নীরব পরিবর্তন। সামোয়ার প্রশান্ত প্রকৃতি আমাকে মোহিত করেছে, আর তাদের ভিন্ন সংস্কৃতি আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে। আমার মনে হয়েছে—পৃথিবীর একমাত্র দেশ হয়তো এটাই, যেখানে আমি আরো কিছুদিন, হয়তো আরো কিছু মাস থাকতে চাই।
কিন্তু অভিযাত্রীর পথ থেমে থাকে না। নতুন দেশের ডাক অপেক্ষায় আছে, আর আমি রওনা হচ্ছি সামোয়ার সীমান্ত ছেড়ে। তবু জানি, আমার স্মৃতির অ্যালবামে সামোয়ার পৃষ্ঠা চিরকাল উজ্জ্বল রঙে ভরে থাকবে—যেন প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের মতো, যা বারবার ফিরে আসে হৃদয়ের তীরে।
প্রকৃতির বিস্ময়
সামোয়ার দ্বীপগুলো জন্মেছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে—গলিত লাভা ঠান্ডা সমুদ্রের সাথে মিশে তৈরি করেছে পাথুরে উপকূল, রহস্যময় গুহা আর অন্তহীন লাভা মাঠ। সাভাই’ই দ্বীপের সেলাউলা লাভা ফিল্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নপ্রায় গির্জা যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী—যে দেখেছে গরম লাভার ঢল, ধ্বংস আর পুনর্জন্ম। সূর্যাস্তের সময় সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে মনে হয়, প্রকৃতি এখানে একই সাথে ভাস্কর, চিত্রশিল্পী এবং কবি।
এখানকার নারীরা চুলে গুঁজে নেয় “সেই” নামের ফুল—ডান কানে রাখলে বোঝায়, তারা অবিবাহিত; বাম কানে রাখলে বোঝায়, তাদের হৃদয় কারও কাছে অর্পিত। জাতীয় ফুল টেউইলা, লাল জিঞ্জারের উজ্জ্বল রঙ, যেন সামোয়ার উষ্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। উৎসবের রাতে ঢোলের তালে নাচে পুরুষ ও নারী, সমুদ্রের ঢেউও যেন সেই তালে দুলতে থাকে।

সামোয়ার গল্পে আছে পলিনেশীয় নাবিকদের তারার দিশায় সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার কাহিনি, আছে ফিজি ও টোঙ্গার সাথে যুদ্ধ ও বাণিজ্যের অধ্যায়, আছে জার্মান, আমেরিকান ও নিউজিল্যান্ডের উপনিবেশের দুঃখগাথা। আর আছে স্বাধীনতার জয়গান—১৯৬২ সালে পলিনেশিয়ার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের গর্ব। এখানেই বসবাস করতেন রবার্ট লুই স্টিভেনসন, যিনি “তুসিতালা” বা গল্পকথক নামে আজও বেঁচে আছেন মানুষের স্মৃতিতে।
২০০৯ সালের সুনামির ক্ষত আজও কিছু মানুষের মনে রয়ে গেছে, কিন্তু তাদের চোখে আছে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা। আমি গ্রাম ঘুরে দেখেছি—কেউ নৌকায় মাছ ধরছে, কেউ নারকেল গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে, শিশুরা খালি পায়ে দৌড়াচ্ছে সবুজ মাঠে। মনে হয়েছে, পৃথিবীর সমস্ত ভ্রমণ শেষে যদি কোথাও শান্তির ঠিকানা খুঁজতে হয়, তবে তা হবে সামোয়া।
রাজধানী আপিয়াতে ঘুরে দেখার মতো অসাধারণ কিছু ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে —
সামোয়ার ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় পলিনেশীয় সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানকার মানুষ তাদের ঐতিহ্যিক “ফা’আ সামোয়া” জীবনধারার মাধ্যমে এখনো তাদের সংস্কৃতি ও পারিবারিক মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সামোয়ান নৃত্য, সংগীত, পোশাক এবং কাঠের হস্তশিল্প সত্যিই চোখে পড়ার মতো। যার সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করেছে।
বিশেষ করে To-Sua Ocean Trench ও Lalomanu Beach ছিল সত্যিই স্বর্গীয় আমার দেখা! এখানকার জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে ছিল “Oka” নারকেলের দুধে ভেজানো কাঁচা মাছ, taro root, আর palusami (নারকেল পাতায় রান্না করা খাবার। এখানকার মানুষের জীবনধারা খুবই সরল, পরিবারকেন্দ্রিক ও প্রাকৃতিকভাবে সংযুক্ত। তারা খুবই আন্তরিক, অতিথিপরায়ণ এবং আত্মিকভাবে সুন্দর। এখানকার আতিথেয়তা, ঐতিহ্যবাহী নৃত্য Siva, ও ‘ফায়া ফায়া’ fire dance বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
সামোয়া আমাকে শিখিয়েছে—.সৌন্দর্য কেবল প্রকৃতিতে নয়, মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে। আর দূরবর্তী সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই দ্বীপ আমার ভ্রমণপথে এক অমলিন কবিতার মতো থেকে যাবে, যেখানে সমুদ্র, আকাশ আর মানুষের হাসি মিলে রচনা করেছে এক চিরন্তন ভালোবাসার গল্প। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের লাল সবুজের এই পতাকা কে আমি এই মাটির উপর দাঁড়িয়ে উড়াতে পেরে এদেশের ইতিহাসের সাথে বাংলাদেশকে সংযোজিত করে এক শান্তিময় অধ্যায় রচনা করলাম। এভাবেই লাল সবুজের পতাকা নিয়ে আমি পৃথিবীর এক দেশ থেকে আরেক দেশে অভিযাত্রা করছি।
সামোয়া থেকে নাজমুন নাহার
বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী পরিব্রাজক




