এশিয়া কাপ মানেই উত্তেজনা ও রোমাঞ্চে ভরপুর এক টুর্নামেন্ট। কারণ এখানেই কেবল দেখা হয় ভারত ও পাকিস্তানের। বিশ্বকাপের ময়দানেও দুই দলের দেখা হয়। তবে এশিয়া কাপে এই দ্বৈরথ যেন দর্শকদের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে আসে। এবারের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে আবহ আগের তুলনায় বেশি উত্তেজিত। আজ রাত সাড়ে ৮টায় দুবাইয়ে সেই দ্বৈরথ মাঠে গড়াবে।
কাশ্মীরের পেহেলগামে গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বন্দুকধারীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৬ জন নিরীহ মানুষ। মর্মান্তিক সে ঘটনার পর দুই দেশ কয়েক দিনের জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিল। দুই পক্ষ একে অপরের ভূখণ্ডে হামলাও চালায়। যুদ্ধ থেমে গেলেও সেই ক্ষত আজও শুকায়নি। নিহতদের পরিবার ও সাধারণ মানুষের মনে রয়ে গেছে ব্যাথা, ক্ষোভ আর ক্ষরণ। এর মাঝেই দুবাইয়ে এশিয়া কাপের মঞ্চে আবার মুখোমুখি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। ফলে ম্যাচটির গুরুত্ব মাঠের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আবেগের অঙ্গনে।
পেহেলগামে ছেলেকে হারানো সঞ্জয় দ্বিবেদীর মতো অনেক স্বজনই চান না ভারত আবার পাকিস্তানের সঙ্গে খেলুক। এই ঘটনার আগে থেকেই দুই দেশ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলা বন্ধ করেছে। পেহেলগামের ঘটনার পরে বৈশ্বিক আসরে ভারত-পাকিস্তান লড়াই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তবে এবারের এশিয়া কাপ সেটি ফিরিয়ে এনেছে। সাবেক ক্রিকেটার হরভজন সিং এবং কেদার যাদব প্রকাশ্যে দাবি তুলেছেন, ভারতের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের ম্যাচ বর্জন করা। এই আবেগ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ম্যাচ বাতিলের আবেদন করা হলেও শুনানির সুযোগ মেলেনি। তবে এতেই বোঝা যায়, দেশ জুড়ে কী তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
ভারতের ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআইও এই আবেগ এড়িয়ে যেতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ম্যাচের দিন বেশির ভাগ শীর্ষ কর্মকর্তা স্টেডিয়ামে থাকবেন না। এ যেন সরাসরি বয়কট নয়, কিন্তু এক প্রকার নীরব প্রতিবাদ। ভারতের অভ্যন্তরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে ম্যাচ বয়কট ক্যাম্পেইন। সব মিলিয়ে মাঠে নামলেও ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসন ও জনগণের এক বড় অংশ এই ম্যাচকে মেনে নিতে পারছে না।
অন্যদিকে পাকিস্তানে চিত্র একেবারেই উলটা। সেখানে ভারত-পাকিস্তান লড়াই মানেই বাড়তি উত্তেজনা, বাড়তি প্রেরণা। পাকিস্তান সুপার লিগের দল করাচি কিংস ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি পাঞ্জাব কিংসকে খোঁচা দিয়ে পোস্ট করেছে, যা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। শোয়েব আখতার, ওয়াসিম আকরামের মতো সাবেকরা ম্যাচ ঘিরে নানা রকম মন্তব্য করে আরও আগুন জ্বালাচ্ছেন।
শোয়েবের মতে, ভারত আসলে পাকিস্তানকে এড়িয়ে ফাইনালে আফগানিস্তানকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চাইবে। অন্যদিকে আকরামের পরামর্শ, শুধু ভারতকে হারানোই পাকিস্তানের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিরোপা জেতা। এশিয়া কাপে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ কোনো নতুন বিষয় নয়। দ্বিপক্ষীয় সিরিজ বহু বছর আগেই বন্ধ হওয়ায় এসিসি কিংবা আইসিসির টুর্নামেন্টই একমাত্র ভরসা। সেখানেই দুই দেশের উত্তেজনা ফুটে ওঠে। এবারও তাই ঘটছে।
ভারত তাদের প্রথম ম্যাচে আরব আমিরাতকে উড়িয়ে দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করেছে। পাকিস্তানও জিতেছে বড় ব্যবধানে। ফলে দু’দল সমান তালে মাঠে নামবে, যেখানে আবেগের চাপ আরও প্রবল হয়ে উঠবে। ম্যাচ ঘিরে রাজনীতি, শোক, প্রতিবাদ আর প্রতিপক্ষকে খোঁচা-সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মাঠের ক্রিকেট হয়তো কখনোই আলাদা করে দেখা যাবে না। তবে ক্রিকেটপ্রেমীরা চান, অন্তত খেলার ভেতরে থাকুক লড়াই, বাইরে নয়। ওয়াসিম আকরাম যেমন বলেছেন, ক্রিকেটকে ক্রিকেট হিসেবেই উপভোগ করতে হবে। এক দল জিতবে, এক দল হারবে-এই স্বাভাবিকতাকে মেনে নিলেই কেবল খেলার সৌন্দর্য টিকে থাকবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, পেহেলগামের রক্তক্ষরণের পর মানুষের মনে যে ক্ষোভ, তা কি ক্রিকেটে ঢাকা পড়বে? নাকি প্রতিটি রান, প্রতিটি উইকেটের সঙ্গেই সেই ক্ষতের দাগ নতুন করে উসকে উঠবে? এই ম্যাচে জয়-পরাজয়ের হিসাবের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে আবেগ, ইতিহাস আর মানুষের মনে জমে থাকা রাগ-ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।