‘রূপবানে’র সাথে কিছুক্ষণ…।

গতকাল (৩ মে, ২০২৪) গিয়েছিলাম- বাঙলা চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা ‘রূপবান কন্যা’ সুজাতার সাথে দেখা করতে। সবাই জানি, ‘সুজাতা’- উনার পোষাকী নাম। উনার পারিবারীক নাম তন্দ্রা মজুমদার। ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট কুষ্টিয়ায় জন্ম গ্রহন করেন তন্দ্রা মজুমদার। ’৬৩ সালে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু-কালে পরিচালক তাঁর পোষাকী নাম রাখেন- সুজাতা। সেই থেকে চলচ্চিত্র দর্শকের কাছে উনি সুজাতা নামেই খ্যাত। আর আমাদের মতো চলচ্চিত্রকর্মীদের কাছে তিনি সুজাতা আপা।

১৯৬৩ সালে সালাউদ্দিন আহমেদের ‘ধারাপাত’-এ অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে সুজাতার অভিনয় জীবনের শুরু। এরপরে, বিগত ৬১ (একষট্টি) বছরে সুজাতা অভিনয় করেছেন প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনও করেছেন।

চলচ্চিত্রে মানসম্পন্ন অভিনয়ের জন্য তিনি লাভ করেছেন ‘আজীবন সম্মাননা’। চলচ্চিত্র শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০২১ সালে তিনি অর্জন করেছেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা- ‘একুশে পদক’। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের একজন সম্মানিত সদস্য।

উনার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে এই মুহুর্তে যে নামগুলো মনে পড়ছে, সেগুলো হলো- ধারাপাত, মেঘভাঙ্গা রোদ, রূপবান, রহিম বাদশা ও রূপবান, রূপবানের রূপকথা, রাজা সন্যাসী, তের নম্বর ফেকু ওস্তাগার লেন, ডাকবাবু, জরিনা সুন্দরী, আয়না ও অবশিষ্ট, আগুন নিয়ে খেলা, এতটুকু আশা, অবাঞ্ছিত, মায়ার সংসার, অবুঝ মন, অশ্রু দিয়ে লেখা, আলোর মিছিল, ছুটির ঘন্টা, রাখাল বন্ধু, মধুমালা, কাঞ্চনমালা …… ইত্যাদি। সুজাতা অভিনীত তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রায় ৫০টির মত চলচ্চিত্র ‘লোক-কাহিনী’ নির্ভর। এই অধিক সংখ্যক লোক-কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য উনাকে ‘ফোক-সম্রাজ্ঞী’ বলা হয়ে থাকে।

সুজাতা অভিনীত ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রটি আজ অব্দি খ্যাত হয়ে আছে পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্রে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে! ** এই ‘রূপবান’চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমি একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি। এই পরিকল্পনাটা করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগেই। কিন্তু করি করি করেও বিভিন্ন কারনে আর করা হয়ে উঠেনি প্রামাণ্যচিত্রটি। এত বছর পরে এবারে আটঘাট বেঁধে নামছি কাজটি সম্পন্ন করবার জন্য।

এই প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়ে চুড়ান্ত কথা বলার জন্যই গিয়েছিলাম ‘রূপবানের’ নায়িকার সাথে কথা বলতে। এ বিষয়ে এর আগে টেলিফোনে কথা বলেছি কয়েকবার। গতকাল সামনা সামনি গিয়ে বিষয়টি চুড়ান্ত করে এসেছি। এখন অল্পকিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়ে গেলেই শুটিং-এ যাবো শীগগির।

‘রূপবান’ চলচ্চিত্রের আরো দু’জন অভিনয়শিল্পী আজো আছেন আমাদের মাঝে (তাঁদের দীর্ঘায়ূ কামনা করি)। একজন তন্দ্রা ইসলাম অন্যজন চন্দণা। তন্দ্রা ইসলাম স্বনামখ্যাত চিত্রগ্রাহক (প্রয়াত) বেবী ইসলামের স্ত্রী। তিনি- ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রে রানীর (রহিম বাদশার মাতা) ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এছাড়াও তিনি- নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ, সংগ্রাম, শুভদা, ক খ গ ঘ ঙ এবং ঘৃণাসহ আরো বেশক’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

চন্দণা- সেই রূপবান চলচ্চিত্রে ‘তাজেল কন্যা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সেই থেকে শুরু করে তিনি গুনাই, মহুয়া, কাঞ্চনমালা, পাতালপুরীর রাজকন্যা, পরিচয়, অপরাধ, মমতা, দাতা হাতেমতাই সহ আরো কয়েকটা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।

সুজাতা (রূপবান), তন্দ্রা ইসলাম (রাণী) এবং চন্দণা (তাজেল) ছাড়াও আরো অনেকের সাথে কথা (ক্যামেরার সামনে) বলতে হবে প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য। চলচ্চিত্র-বোদ্ধা, সমালোচক, সাংবাদিক, দর্শক, গবেষক, পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, তখোনকার দর্শক এবং নতুন প্রজন্মের দর্শকের সাথে কথা বলতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে। আশা করছি চলতি বছরের (২০২৪) শেষ নাগাদ প্রামাণ্যচিত্রটি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হবো।

** বলে রাখা ভালো- বরাবরের মতো এই প্রামাণ্যচিত্রটিও নিজের অর্থায়নেই সম্পন্ন করতে যাচ্ছি।

একটি বিষয়ে একটু বলে রাখতে চাই।

পঞ্চাশ দশকের পুরোটাই এবং ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্ব বাংলার (তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তানে) চলচ্চিত্রাঙ্গণে পাকিস্তানি চলচ্চিত্র যেভাবে এক চেটিয়া ‘মোড়লগিরী’ করে যাচ্ছিল- সে জায়গায় লোককাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ তার গ্রহনযোগ্যতা আর জনপ্রিয়তা দিয়ে এই অঙ্গণের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এই চলচ্চিত্রটি একদিকে যেমন আমাদের সমৃদ্ধ লোক-কাহিনীকে চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছে সফলতার সাথে, অপরদিকে এই চলচ্চিত্রের (রূপবান) ব্যবসা-সফলতা বাজারের প্রচলিত হিসাব-নিকাশকে বদলে দেয় এক লহমায়! এবং বাজারে নতুন মাত্রা প্রদান করে!

জহির রায়হানের মত প্রতিভাবান নির্মাতারা তখোন ‘পাকিস্তানি বলয়’ থেকে বেরিয়ে এসে বাঙলার লোক কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন! অথচ অত্যন্ত প্রতিভাবান এই নির্মাতা (জহির রায়হান) পঞ্চাশ দশকে চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত পাকানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র কেন্দ্র লাহোরে যেতে বাধ্য হন এবং পাকিস্তানি নির্মাতা এ.জে. কারদারের (আহমদ জং কারদার) সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করেন।

ওখানে নিজেকে তৈরি করার পরে জহির রায়হান বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি নিজে উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকেন। পুরো পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গিন উর্দু চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ নির্মাণ করেন তিনি ১৯৬৪ সালে। এবং পাকিস্তানের প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ও কিন্তু জহির রায়হানই নির্মাণ করেছেন ১৯৬৫ সালে।

কিন্তু, পরিচালক সালাহ উদ্দিনের ‘রূপবান’-এর ভূবন-কাঁপানো সাফল্যের পর জহির রায়হান উর্দু ছেড়ে বাংলার লোককাহিনীর ওপরে ঝুঁকে পড়েন। সেই সময়ে তিনিই আবার নির্মাণ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের মাইলফলক ‘বেহুলা’র মতো লোক-কাহিনী নির্ভর জনপ্রিয় চলচ্চিত্র।

‘রূপবানে’র জনপ্রিয়তার একটি ‘গল্প’ বলি আপনাদের কাছে।

রূপবানের কাহিনী এবং গানের প্রভাব সাধারণ দর্শকের কাছে এতটাই প্রবল ছিল যে, খুব অল্পদিনের মধ্যেই ‘রূপবান’ পাড়ায় মহল্লায় মঞ্চ নাটক এবং যাত্রা পালা হিসেবে পরিবেশিত হতে থাকে। কথিত আছে, এই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলের কোন একটি স্থানে এই পালাটি পরিবেশনের সময় স্থানীয় একজন চেয়ারম্যান ‘রূপবান’ চরিত্র’টির প্রেমে মজে যান। ৭ কিংবা ১০ রজনী- পালাটি পরিবেশনের সময় ওই চেয়ারম্যান প্রতিরাতেই পালাটি উপভোগ করেন এবং যাত্রা-মঞ্চের একটি ‘খুঁটি’কে টার্গেট করেন! অভিনয়ের সময় ‘রূপবান চরিত্রটি’ সুনির্দিষ্ট সেই খুঁটিটি ধরে বিরহের গানগুলো পরিবেশন করতেন কিংবা কান্নায় ভেঙ্গে পড়তেন! এটাসেই চেয়ারম্যানকে ভীষণ আপ্লুত করে!

১০-দিনের পালা গানশেষে রূপবানের প্রেম-মজা ওই চেয়ারম্যান যাত্রা দলের কাছ থেকে তাঁর ‘টারগেটেড’ সেই খুঁটিটি (১৯৬৬ সালে) নাকি ৮০০/- (আটশত) টাকা দিয়ে কিনে রেখে ছিলেন- ‘রূপবানের’ স্মৃতি হিসেবে। উল্লেখ্য, সে সময়ে স্বর্নের ভরি ছিল ৬০/- কিংবা ৬৫/- (ষাট কিংবা পঁয়ষট্টি) টাকা।……এই ছিল ‘রূপবানের’ জনপ্রিয়তার নমুনা!

শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী এই স্তরই নয়, ‘রূপবান’ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণের পেছনে আরো অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কারন বিদ্যমান। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরে সেগুলো আপনাদের সামনে পর্দায় তা উপস্থাপন করতে পারবো বলে আশা করছি।

সূত্রঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা কাওসার চৌধুরীর ফেসবুক থেকে।

এস/ভি নিউজ

পূর্বের খবরমন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা নীতিগত সিদ্ধান্ত, আইনি বিষয় নয়: কাদের
পরবর্তি খবরসোশাল মিডিয়াকে শিশুদের জন্য নিরাপদ করা