মুজিবনগর সরকার : বাংলাদেশের প্রথম ও সফল সরকার

 

জয়ন্ত আচার্য

আজ ১৭ এপ্রিল, ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। পরে এ বৈদ্যনাথতলাকেই মুজিবনগর হিসাবে নামকরণ করা হয়। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির দ্বিতীয়টি নেই যে, এ ধরনের সরকার দেশের স্বাধীন ভূমিতে শপথ গ্রহণ করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রবাসী সরকার সবসময় বন্ধুভাবাপন্ন সহযোগী দেশের মাটিতে গঠিত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে মুজিবনগরই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। অবশ্য নিরাপত্তার কারণে রাজধানীর সদর দফতর ছিল কলকাতায়। দ্বিতীয়ত, এই সরকার ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। সুতরাং এই সরকার ছিল সম্পূর্ণ সাংবিধানিক, জন প্রতিনিধিত্বশীল ও বৈধ। এই সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম মুক্তিযুদ্ধ। ‘১৯৭১-এ আমাদের যুদ্ধটি ছিল ইতিহাসের সফল সংক্ষিপ্ততম মুক্তিযুদ্ধ।

১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়েছিল। মূলত ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলা বা মুজিবনগরে এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১০ এপ্রিল এই সরকার স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে । ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনারা ঢাকা সহ সারা দেশে গণহত্যা পরিচালনা করে ও গ০্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকে । গ্রেফতার হওয়ার আগেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ রাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন । এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় মুজিব নগর সরকার ।

মুজিব নগর সরকরের ছয় সদস্যের মন্ত্রিসভা ছিল এই সরকারের কেন্দ্রবিন্দু। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপতি। তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। অন্যান্য সদস্য ছিলেন: খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল বারোটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। সরকারের কর্মকাণ্ডে তিন ধরনের বিভাজন ছিল: বেসামরিক প্রশাসন, সামরিক বিষয়াবলি (প্রধান বিষয়) এবং স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা। প্রধানত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা এই সরকারের প্রধান কাজ হলেও যুদ্ধ-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কেও এই সরকার সচেতন ছিল এবং তার প্রমাণ ছিল পরিকল্পনা সেল গঠন। সেলটির প্রধান ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী । অন্যান্য সদস্য ছিলেন: অধ্যাপক ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক ড. মোশারফ হোসেন, ড. এস আর বোস ও ড. আনিসুজ্জামান।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যার অভিযান শুরু হলে সামরিক-বেসামরিক বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। সূচনা-পর্বে মুক্তিযুদ্ধ ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণহীন ও সমন্বয়হীন, । মুজিব নগর সরকার গঠিত হোয়ার পরই পরিকল্পিত ভাবেই যুদ্ধ পরিচালিত হয় । ১৫ জুলাই মুজিবনগর সরকারের দিকনির্দেশনা ও উদ্যোগে সারা বাংলাদেশকে যুদ্ধের এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়, প্রত্যেক সেক্টর একজন অধিনায়কের অধীন ন্যস্ত করা হয়।উপরন্তু ছিল বিশেষ বাহিনী।

বাংলাদেশের প্রখম এসরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্বের বিরোধিতা সত্ত্বেও সারা বিশ্বের জনমত ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। এমনকি মার্কিন সরকার বিরোধিতা করলেও অসংখ্য মার্কিন রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বিজয় অর্জনের অনেক আগেই বিশ্বজনমতের রায়ে আমাদের নৈতিক বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল । এ বিজয়ের কৃতিত্ব মুজিবনগর সরকারের। এই সরকারের সাফল্যের কারণেই ১৬ ডিসেম্বরের আগেই ভুটান ও ভারত বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিল।

মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় সৈন্যদের সকল ধরনের সমর্থন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেছে। ভারতীয় সৈন্যরা শুধুমাত্র আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংই দেননি, যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও প্রেরণ করেছেন। যার ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন এবং পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে পেরেছেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার সৈন্যরা যখন আত্মসমর্পণ করলো তখনই মুজিবনগর সরকার রাজধানী ঢাকায় এসে নতুন একটি দেশ বাংলাদেশের সকল দায়িত্ব বুঝে নেয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন ভারতে নামলেন তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারত সরকার লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলে বাংলার জনগণ হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়েই তাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বরণ করে নেয়। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের ব্যবস্থার রূপরেখা প্রণয়ন করেন, যার ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।

মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের প্রথম সরকার ছিল–একটি সফল সরকার। সাফল্য ছিল মাত্র নয় মাসে বিজয় অর্জন করা। সাফল্য ছিল বিশ্বজনমতকে বাংলাদেশের সপক্ষে টেনে আনা। সাফল্য ছিল সামরিক বিজয়ের আগেই কূটনৈতিক সাফল্যের সূচক হিসেবে ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতি অর্জন করা।

মুজিবনগর সরকার হচ্ছে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার, তাই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসটি বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথা দিন। জাতির জন্য এদিনটি একটি ঐতিহাসিক দিনও বটে। এই কারণেই বাংলাদেশের জনগণ দিবসটিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিকা হিসেবে এবং জাতির চেতনাবোধ জাগ্রতের দিন হিসেবে পালন করে থাকে।তাই নতুন প্রজন্মকে মুজিব নগর সরকারের ইতিহাস জানাতে হবে । এই ইতিহাস প্রবাহিত করতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ।

লেখক : সম্পাদক ভিনিউজ ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি আজকাল (ভারত )
সদস্য , সাংস্কৃতিক উপকমিট কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ , সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ঢা:বি

পূর্বের খবরনিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে : বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী
পরবর্তি খবরমুজিবনগর সরকার: ১৯৭১ সালে যেভাবে শপথ নিয়েছিল বাংলাদেশের