বাংলা নববর্ষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ

শেখর ভট্টাচার্য

বাঙালির নববর্ষ একটি অনন্য উৎসব। ধর্মীয় অনুষঙ্গহীন এরকম সর্বজনীন জাতীয় উৎসব পৃথিবীতে বিরল। বাংলা নববর্ষের সর্ব জনীনতার কারণে অনিন্দ্য সুন্দর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত উৎসব। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন, পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে-দিনে পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ।

বাংলা নববর্ষের উৎপত্তির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে মুঘল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর সিংহাসন আরোহণের সময় (৯৬৩ হিজরি) ‘ফসলি সন’ নামে যে সন প্রবর্তন করেন যা কালক্রমে ‘বাংলা সন’ নামে পরিচিত লাভ করে। বাংলা সন প্রবর্তনের পূর্বে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা করা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষির হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যেত। এতে কৃষকদের ‘ফসলি সন’ গণনায় সমস্যা তৈরি হয়। ফলে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায় করতেও সমস্যা দেখা দেয়। জমিদার ও কৃষকদের সুবিধার্থে ও এই সমস্যা দূর করতে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। কৃষি হলো বাংলার অর্থনীতির প্রাণ। কৃষিকাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য অর্থাৎ অর্থনীতিকে সচল করা জন্যই বাংলা নববর্ষের সূচনা ঘটে। যারা আজকাল বাংলা সনের সাথে বিভিন্ন ধর্মের অনুষঙ্গ খুঁজে বেড়ান তারা অনেকেই এই তথ্য জানার পরও অন্ধকার ঘরে কালো বেড়াল অনুসন্ধানে নামেন।

দুশ বছর আগে জমিদারিপ্রথা প্রবর্তনের পর এদেশের জমিদাররা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বাংলা নববর্ষকে সামাজিক উৎসবে রূপান্তরিত করেন। রাজধানী ঢাকায় ব্যবসায়ীদের হালখাতার গন্ডি পেরিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনটি শেকড়সন্ধানী বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হওয়ার সূচনা ঘটেছে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। ছায়ানটের উদ্যোগে ঢাকায় বাংলা নববর্ষ প্রথম কয়েক বছর উদযাপিত হয়েছে বলধা গার্ডেনে। জনসমাগম বাড়ার কারণে ১৯৬৭ সাল থেকে মূল আয়োজন রমনার বটমূলে স্থানান্তরিত হয়েছে। ছায়ানটের শিল্পীরা বৈশাখের প্রথম সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রমনা পার্কের বটমূলে রবীন্দ্রনাথের বর্ষবন্দনার মাধ্যমে উৎসবের সূচনা করেন। এরপর যুক্ত হয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, যেখানে অংশগ্রহণ করে সর্বস্তরের মানুষ। রাজধানীর বাইরে বাংলাদেশে এমন কোনো জনপদ নেই, যেখানে ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় না।

বাংলা নববর্ষকে প্রান্তিক মানুষেরা বিশেষ করে কৃষক সম্প্রদায় অত্যন্ত লোকজ প্রকৃতিতে উদযাপন করতেন এক সময়। উৎসব উদযাপনের মধ্যে অন্তরের যোগ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে নাগরিক চাকচিক্য তেমন ছিল না। বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকের পূর্বে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ গ্রামে-গঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের পথ বন্ধ করার জন্য যখন পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা শুরু করে তখন নব উদ্যমে অতীত ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় পূর্ববাংলার সবাই শ্রেণির বাঙালি। এ প্রচেষ্টা আরও জোরদার হলো যখন পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মকে নানাভাবে পূর্ববাংলায় অবদমিত করার প্রচেষ্টা চলালো। ষাটের দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বলা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, ভারতীয়; পাকিস্তানের আদর্শের পরিপন্থি। এর আগে তারা বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে অভিহিত করে এর ইসলামিকরণের এক হাস্যকর অথচ ভয়ংকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।

বাংলা নববর্ষ পালনের সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশেরও একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যখন আমাদের এই বাংলাদেশে একটি জাদুকরি নবজাগরণ বা রেনেসাঁস সংগঠিত হলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি তার কৃষ্টি এবং ঐতিহ্য সচেতন হয়ে পড়ল। এই ঐতিহ্য সচেতনতার কারণে পঞ্চাশের দশক থেকে ঢাকায় এবং সারা দেশে প্রভাতী সংগীতের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ পালনের আয়োজন শুরু হয়। নবজাগরণের কালেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বেশ কিছু সংগঠনের জন্ম হয় এবং এসব সংগঠন বাঙালি সংস্কৃতির নিবেদিত চর্চার মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে সহায়তা দান করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য ‘ছায়ানট’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’, ‘সন্দীপন’ প্রভৃতি সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মলাভ করে। ছায়ানটই উদ্যোগ নিয়েছিল রাজধানী ঢাকায় সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের, যে সংগঠনের মধ্যমণি ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও সানজিদা খাতুন শিল্পী দম্পতি।

ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা মূর্ত হয়েছে ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে এবং পরিণতি লাভ করেছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভেতর ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্র তৈরি করেছে ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেরও ভিত নির্মাণ করেছে।

আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের ওপর বহুবার আঘাত এসেছে পাকিস্তানি আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে। ষড়যন্ত্র করা হয়েছে ধর্মের নামে ভিনদেশি সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার। বাঙালি বীরের জাতি, সেটা মেনে নেয়নি। বাংলা নববর্ষে আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে সেই ঘৃণ্য অপচেষ্টা ভেসে গেছে কচুরিপানার মতো। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বাংলা নববর্ষ অনুঘটকের মতো কাজ করেছে। জুগিয়েছে সামনে চলার অনন্ত প্রেরণা। স্বাধীন বাংলাদেশে একুশে উদযাপনের মতো বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরোধিতা এসেছে নিষ্ঠুর উপায়ে।২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মৌলবাদী জঙ্গিরা বোমা হামলা করে বহু মানুষকে হতাহত করে। পরের বছর যখন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়, রমনার বটমূলসহ বাংলা নববর্ষের সব অনুষ্ঠানে জনসমাগম দ্বিগুণ হয়েছে, উৎসব আর প্রতিবাদ একাকার হয়ে গেছে। রাজধানীতে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে ধর্ম-বর্ণ, বিত্ত-লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ। কণ্ঠে ধারণ করেছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালনের কালজয়ী গান, যেখানে মূর্ত হয়েছে বাঙালিত্ব ও মানবতার শাশ্বত চেতনা।

অনেকেই ভেবেছিলো বোমা হামলার পর নববর্ষ পালনের অনিন্দ্য সুন্দর অনুষ্ঠানগুলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। একুশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মতো নববর্ষের অনুষ্ঠানগুলো অন্ধকারের কুশীলবদের কাছে অত্যন্ত ঘৃণ্য অনুষ্ঠান। একুশের হাত ধরে বাংলা নববর্ষের প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল এই বাংলায়। একুশ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শানিত করেছিল এবং এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল হলো স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিরোধীদের তাই একুশ ও বাংলা নববর্ষের প্রতি সমান ঘৃণা। এ কারণেই নববর্ষ উদযাপনকে নিকৃষ্ট উপায়ে বন্ধ করে দিতে তারা বারে বারে উদ্যত হয়।

২০০১ সালের বোমা হামলার পর বর্ষবরণ অনুষ্ঠাণ উদযাপন সম্পর্কে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সনজিদা খাতুন বলেছিলেন- ‘১৯৬৭ সালে সেই পরাধীনতার আমল থেকে নববর্ষের আবহনী করে আসছি। তখন প্রাণে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। সেই উচ্ছ্বাসে ২০০১ সালে আঘাত আসে। বোমা হামলা হয়। এরপর ছায়ানট নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ হিংসাত্মক আচরণ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ নয়। এ হিংসা অশিক্ষা থেকে এসেছে। মুখস্থ করে খাতায় উগরে দিলে তা শিক্ষা হয় না। সত্যিকারের শিক্ষার জন্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ অপরিহার্য। এ পথেই উদ্ধার সম্ভব। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ না ঘটলে এ দেশ থেকে অজ্ঞ ও অজ্ঞতা দূর হবে না। অন্তর থেকে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হলেই আমরা মানুষ হতে পারব। হতে পারব সম্পূর্ণ বাঙালি।

২০০১ সালে যখন ছায়ানটের অনুষ্ঠাণে বোমাবর্ষণ হয় তখন সনজিদা খাতুন মঞ্চ ছেড়ে একচুলও নড়েননি। আবহমান বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষার জন্য লৌহ কঠিন দৃঢ়তায় তিনি মঞ্চে অবস্থান নিয়েছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত শক্তি এত প্রবল যে আঘাত পেলেই হাজারগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসে। যারা শহীদ মিনার ভেঙ্গে মনে করে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতিকে সাম্প্রদায়িকতার চাদর দিয়ে মুড়ে দিতে পারবে তারা বাঙালি জাতিসত্তার ইতিহাস জানেনা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি আদর্শের ধারকরা কখনো ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেনি। ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই তারা ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করে বঙ্গবন্ধু এবং তার সহযোগীদের। যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও একটি অনন্য সাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সাথে সাথে তাই সচেতন নাগরিকদের মনে রাখতে হবে, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা।

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেতরে ভেতরে মৌলবাদের সঙ্গে আপস করেছে কিংবা উপেক্ষা করেছে । বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কখনো এদেশে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের প্রত্যাবর্তন মেনে নেয়নি। এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ হচ্ছে সাড়ম্বরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন এবং গোটা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মহিমা কীর্তন। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ প্রবল শক্তি, সাহস ও সংগ্রামের সংকল্প নিয়ে হাজির হয় বাংলাদেশে। বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা চেতনার চিরন্তন শিখা বাংলা নববর্ষ। একুশের মতো বাংলা নববর্ষও চিরদিন আমাদের শুভপথে, মঙ্গলের পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়ে যাবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

এস/ভি নিউজ

পূর্বের খবরবাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ
পরবর্তি খবরআন্তর্জাতিক চাপেই মুক্ত নাবিকরা: নৌপ্রতিমন্ত্রী