মার্চেই ঢাকা-চট্টগ্রাম চূড়ান্ত নকশা

চার লেনে উন্নীত করার আট বছরের মাথায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কাজ শুরুর আগে করা হচ্ছে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিস্তারিত নকশা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি ছয় নাকি আট লেনে উন্নীত করা হবে, চলমান সমীক্ষা সম্পন্নের পর সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর এ সমীক্ষার কাজ চলতি মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনের পর প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু হবে বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, নির্মাণ-পরবর্তী ১৫ বছর যেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আর কোনো কাজ করতে না হয়, সে লক্ষ্যেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটির দুই পাশে ২৭টি বাজার ও অনেক  সড়কের সংযোগস্থল রয়েছে। যেগুলো সরাসরি মহাসড়কটিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এ মহাসড়কটি যদি এক্সপ্রেসওয়ে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় তাহলে বিভিন্ন জংশন পয়েন্টে (আঞ্চলিক সড়কে সংযোগ ও হাটবাজার) পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের মতো ইন্টারচেঞ্জ করতে হবে। যেন এক্সপ্রেসওয়েতে স্থানীয় পরিবহন ও হাটবাজারের মানুষ বাধা তৈরি না করে। ৩০০ ফিট সড়ক অর্থাৎ পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের মতো হলে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ভূমিকা রাখবে এ মহাসড়কটি।

জানা যায়, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার আর তিন পার্বত্য জেলার কারণে মহাসড়কটি একই সঙ্গে দেশের প্রধান পর্যটন করিডোরও। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে মহাসড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে ও সাসেক করিডোরে সংযুক্ত হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতিদিন ৩০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে বলে ২০২০ সালে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মহাসড়কটিতে চলাচলরত যানবাহনের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বিদ্যমান চার লেনে সক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করায় বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরি হচ্ছে যানজট। এতে বিঘিœত হচ্ছে পণ্য পরিবহন। যদিও ২০১৩ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে এক্সপ্রেসওয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেও গত বছর প্রকল্পটি বাতিল করে সরকার। তবে দেশের অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ খ্যাত মহাসড়কটিতে ইতোমধ্যে ধারণক্ষমতার বেশি যানবাহন চলাচল করছে। ফলে পিপিপির মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ে না করে বিদ্যমান চার লেন বিশিষ্ট মহাসড়কটি আট লেনে প্রশস্তকরণ ও উভয় পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার বিস্তারিত নকশা ও সমীক্ষা চলতি মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে পুরো মহাসড়ক আট লেন হবে না। যানবাহনের চাপের ওপর ভিত্তি করে কোথাও ছয় লেন, কোথাও আট লেন হবে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আয়োজনে প্রকল্পটির প্রস্তাবিত ডিজাইনের ওপর মতবিনিময় সভায় এসব কথা জানান সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। ওই সভায় তিনি আরও জানান, নারায়ণগঞ্জের মদনপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের বারইয়ারহাট থেকে সিটি গেট পর্যন্ত যেসব স্থানে যানজট তৈরি হতে পারে, সেগুলোয় ওভারপাস করে দেওয়া হবে। যেসব স্থানে সড়ক বাঁকা, সেগুলো সোজা করা হবে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটিতে অর্থায়নে অনেক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা আগ্রহও দেখিয়েছে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ২৩২ কিলোমিটার মহাসড়কটি আট লেনে উন্নীত করতে খরচ হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলাদা তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশস্ত করা হবে মহাসড়কটি। একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে বৃহত্তর ঢাকা অংশের তিন জেলায় (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ)। এ অংশে সড়কের দৈর্ঘ্য ৩৮ কিলোমিটার; যা বাস্তবায়নে খরচ হবে ৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। আরেকটি প্রকল্প হবে বৃহত্তর কুমিল্লা অংশের দুই জেলায় (কুমিল্লা, ফেনী)। এ অংশে সড়কের দৈর্ঘ্য ১২৫ কিলোমিটার। এটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ৪৫ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। আরেকটি বাস্তবায়িত হবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অংশে; যেটি হবে মূলত ফেনী থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত। এতে খরচ হবে ১৮ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ অংশের দৈর্ঘ্য ৬৯ কিলোমিটার। তিনটি প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৭৩ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণ চাওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা সরকার জোগান দেবে। চলতি বছর শুরু হয়ে ২০২৯ সালে সড়ক প্রশস্তের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ)।

এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণের জন্য গত এপ্রিলে একটি সমীক্ষার কাজ শুরু করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসির নেতৃত্বে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়াম মাঠপর্যায়ে সমীক্ষাটি পরিচালনা করছে। সওজ অধিদফতরের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী, মহাসড়কটি সম্প্রসারণে একটি বিস্তারিত নকশাও তৈরি করে দেবে এ কনসোর্টিয়াম। এসব কাজে খরচ হচ্ছে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন সমীক্ষা চলছে। এ মাসে সমীক্ষার কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। এখন পর্যন্ত মহাসড়কটি চার লেন এক্সপ্রেসওয়ে করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর মহাসড়কটির দুই পাশে থাকবে সার্ভিস লেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অর্থাৎ বাজার এলাকায় ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। আর ওভারপাসের নিচে ইউটার্ন থাকবে। তবে সবই সমীক্ষা শেষ হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। কোথায় কী করা যাবে সমীক্ষা রিপোর্ট হাতে এলে চূড়ান্ত নকশা করা হবে। এর পরই প্রকল্পের জন্য ডিপিপি তৈরি করা হবে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে। অথচ এ চার লেনের কোনো সুবিধা আমরা পাইনি। কারণ একটি হচ্ছে হাটবাজার, অন্যটি হচ্ছে মহাসড়কটি থেকে অন্য সড়কের সংযোগস্থলে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের চাপ। একই সঙ্গে ভারী যানবাহনগুলো দিনের বেলায় সড়কের দুই পাশে যত্রতত্র এক লেন দখল করে রাখে। এ তিনটি কারণে সুবিধা পাইনি। শুধু সড়ক প্রশস্ত করলে হবে না, ব্যবহার নিশ্চিতও করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু হাটবাজার এলাকায় ওভারপাস করলে এটা এক্সপ্রেসওয়ে হবে না। এক্সপ্রেসওয়ে মানে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। জংশন পয়েন্টগুলোতে কার্যকর ভাবে ব্যবহার করা। একই সঙ্গে এ পয়েন্টগুলোতে ইন্টারচেঞ্জ তৈরি করা। আর সার্ভিস লেনকে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে আলাদা করে দেওয়া। পার্কিং নিয়ন্ত্রণ করা। ট্রাকের জন্য আলাদা স্ট্যান্ড তৈরি করা যেন যত্রতত্র এক্সপ্রেসওয়েতে না থাকে।’

রাজধানীর ৩০০ ফিট সড়কের উদাহরণ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘৩০০ ফিট সড়কের জংশন পয়েন্টগুলো খুব সুন্দর। এখানে এক্সপ্রেসওয়ের গাড়ি আন্ডারপাস দিয়ে তার গতিতে চলে যাচ্ছে। আর যারা ইউটার্ন করবে তারা সার্ভিস লেনে গিয়ে ওপর দিয়ে ইউটার্ন করে এক্সপ্রেসওয়েতে ঢুকছে। তবে এর বাইরে জায়গা থাকলে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ভাঙ্গার মতো ইন্টারচেঞ্জ করতে পারে।’

পূর্বের খবরআসন্ন লোকসভায় ৪২ আসনের ২৬টিতেই নতুন মুখ তৃণমূলের
পরবর্তি খবর৩ সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে চাকুরিচ্যুত করল সরকার