প্রেরণার শক্তি জয় বাংলা

Share

ড. সুলতান মাহমুদ রানা

বাংলাদেশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে রাষ্ট্রীয় স্লোগান করা হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনো সাধারণ মহলে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সকল সাংবিধানিক পদ, সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বাধ্যতামূলক। এমনকি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ্যাসেম্বলি, সভা-সমাবেশ, সেমিনারে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার করার বিধান এবং নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা এবং তা নিয়ে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে কিনা– এমন দুটি বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ২০২০ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্টের তরফে এক রায়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই আলোকে ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সশস্ত্র যুদ্ধে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির অফুরন্ত প্রেরণার উৎস। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুসারে যার যা-কিছু আছে তাই নিয়ে দেশের সব মানুষ বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ‘জয় বাংলা’ বলে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাসহ সবার বুকে স্পন্দিত ও মুখে উচ্চারিত আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার। এই স্লোগান আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সফল হাতিয়ার। মূলত এই হাতিয়ারের বলেই আমরা পরাভূত করতে পেরেছিলাম পাহাড় সমান প্রতিপক্ষকে। যার ফলে জয় করেছি আমাদের আসল পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মায়ের মুখের বাংলাভাষা ও মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগে রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে উচ্চারিত হতে থাকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি। ছাত্র আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়টাতেও এই স্লোগান দিয়েছিলেন ছাত্রনেতারা। একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করে একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস অর্জনের পথ ছিল বজ্রকণ্ঠ আকাশে তুলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া। তাদের বীরত্ব প্রকাশের ভাষাটিও ছিল ‘জয় বাংলা’।

স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলন করেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। সেই সঙ্গে বারবার উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ভঙ্গ করা হয় কার্ফু। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে বাঙালি।

১৯৪৭-এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। সারা বাংলায় সেই একই স্লোগান জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব দেওয়া হয়। সরাসরি এই নামকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের গন্ডি অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান হয়ে যায় সব মুক্তিকামী মানুষের।

১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন-‘ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মারা গেছে, স্বাধিকার অর্জনের জন্য বাংলার আরও ১০ লাখ প্রাণ দিবে’। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬৯ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জয় বাংলা ধ্বনিতে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন লাভ করে। প্রমাণিত হয় বাঙালি জাতির বজ্রকঠিন ঐক্য। আরও অপরিসীম হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র জয় বাংলার শক্তি।

‘জয় বাংলা/জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা/ শেখ মুজিব, শেখ মুজিব, বীরবাঙালি অস্ত্র ধরো/ বাংলাদেশ স্বাধীন করো, তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা, জাগো জাগো/ বাঙালি জাগো। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা…’। জয় বাংলা উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী, তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষর সংগীত ছিল জয় বাংলা, বাংলার জয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল ১৯৭১ প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘জয় বাংলার লোক’ অভিহিত করেই স্বাধীনতার পক্ষের লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও দোসররা। অবশেষে বীর বাঙালির ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৫টায় বাংলাদেশ ও ভারতের মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সৈন্যরা শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কাক্সিক্ষত স্বাধীন বাংলাদেশ।

যারা নতুন প্রজন্ম, তাদের একাত্তর দেখা হয়নি। তবে প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’র শক্তি অনুভব করেছে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত গঠনের সময়। ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার অদেখা মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ পেয়েছে কোনো রকম দলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। ওই সময়ে অনেক বছর পর রক্ত দিয়ে কেনা হারিয়ে যাওয়া প্র্রিয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্র্রকম্পিত হয় সারাদেশ।

জয় বাংলা বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও সেটির যথাযথ প্রয়োগ সকল ক্ষেত্রে আমরা মোটেও দেখতে পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন হলো– রিফারির স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার শক্তি এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে কেন সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রবণতা আজও গড়ে উঠছে না। মনে রাখতে হবে, জয় বাংলা কোনো দলীয় স্লোগান নয়, এর মালিক দেশের আপামর জনসাধারণ। যারা মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে, তারাই জয় বাংলা স্লোগানকে লালন করে এবং ধারণ করে। সকলেরই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপোসহীন থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটি না হওয়ার প্রবণতাকে কোনোভাবেই ইতিবাচকভাবে দেখা যায় না। আমাদের বুঝতে হবে, বাংলাদেশ মানেই হলো জয় বাংলার শক্তি। দেশের আপামর জনসাধারণ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে দল-মত নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারণ করেছে। কাজেই পরিশেষে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধ যেমন বাঙালির অস্তিত্ব, ঠিক তেমনি জয় বাংলা স্লোগানও বাঙালির প্রেরণা শক্তি। ফলে, সকল ক্ষেত্রে এই স্লোগান প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

লেখক: অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এস/ভি নিউজ