জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন হিসাব নিকাশ শুরু হয়েছে। দলগুলোর মধ্যে বড় জোট করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ রয়েছে সুবিধাজনক অবস্থানে। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো ছাড়াও আরও অনেক দল এ জোটে আসতে চাচ্ছে। তবে তফসিল প্রত্যাখ্যান করে রাজপথের আন্দোলনে থাকা বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগ জোটের পরিধি আরও বাড়াবে। আর তা না হলে ১৪ দলীয় জোটেই নির্বাচন করবে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ও তৃণমূল বিএনপির পৃথক পৃথক জোট করে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগসহ ৭টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধভাবে নৌকা প্রতীকে ভোট করতে সিইসি বরাবর আবেদন করেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করতে ইসিতে আবেদন করা অন্য ৬টি রাজনৈতিক দল হচ্ছে- ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ, ইনু), জাতীয় পার্টি (জেপি), বিকল্প ধারা (বি. চৌধুরী) সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি তারা জোটের অধীন নৌকা প্রতীকে ভোট করতে চায় বলে ইসিকে জানিয়েছে। তাই নির্বাচনে জোটগত প্রতীক বরাদ্দের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে (সিইসি) চিঠি দিয়েছেন। বিকল্প ধারা নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে নৌকা ও কুলা প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ চেয়েছে।
এ ছাড়া তৃণমূল বিএনপির সোনালি আঁশ প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রগতিশীল ইসলামী জোট। এ জন্য প্রগতিশীল ইসলামী জোট প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হবিবুল আউয়াল বরাবর এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছে। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না এলে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও বেশ ক’টি নিবন্ধনহীন দলকে জোটে ভিড়িয়ে নির্বাচন করতে চায়। সে ক্ষেত্রে তাদের লাঙ্গল প্রতীক দেওয়া না গেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করিয়ে জাতীয় পার্টি থেকে সমর্থন দেওয়া হবে বলে সূত্র জানায়।
এদিকে বিএনপি নির্বাচনে এলে প্রয়োজনে যাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আগের মতো মহাজোটে নির্বাচন করা যায় সে জন্য জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে নৌকা ও লাঙ্গল প্রতীকে ভোট করার সুযোগ চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। যদিও জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করবে জানিয়ে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের সিইসিকে আলাদা একটি চিঠি দিয়েছেন।
অপরদিকে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বর্জন করলেও নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়নি। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল ভেতরে ভেতরে বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমানে বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিপরীতমুখী অবস্থানে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, শেষ মুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে নাটকীয় কোনো মোড় নিলে বিএনপি নির্বাচনে এলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আর বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তাহলে বর্তমানে তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ছোট ছোট প্রায় দুই ডজন রাজনৈতিক দলও নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে এসব দলের বেশিরভাগই নিবন্ধনহীন। বিএনপি নির্বাচনে গেলে তারা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি নির্বাচনে গেলে নির্বাচন কমিশন হয়তো সংসদ নির্বাচনের সময় ৭ জানুয়ারির পরিবের্তে আরও কিছুদিন সময় বাড়িয়ে আবারও তফসিল ঘোষণা করবে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলো এখনো আসন বণ্টনের বিষয়টি ফয়সালা করার তাগিদ দিলেও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে তাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। কারণ, বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না ত এখনো নিশ্চিত হয়নি। বিএনপি নির্বাচনে গেলে জোটের পরিধি ও আসন বণ্টন হবে একরকম, আর তারা নির্বাচনে না গেলে হিসেব-নিকাশ হবে অন্য রকম।
উল্লেখ্য, ২৮ অক্টোবরের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক জোট গঠনের মেরুকরণ ছিল একরকম। আর ওই দিন বিএনপির মহাসমাবেশ প- হওয়ার পর বিএনপি কঠোর আন্দোলনের দিকে যাওয়া ও দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর জোট গঠনের মেরুকরণ হয়ে যায় আরেক রকম। কারণ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কিছু দল নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কোনো কোনো দল আবার ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জোট করার জন্য যোগাযোগ করে। আবার বিএনপির ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা তৃণমূল বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচন করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এর ফলে পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতিই পাল্টে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের দৌড়ঝাঁপ ও বিএনপির আন্দোলনের গতি দেখে এক পর্যায়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া ওই দলের নেতারা সরকারের কঠোর সমালোচনায়ও লিপ্ত হয়। তাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে কি নেবে না এ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিন্তু বিএনপির আন্দোলন গতি হারানোর পর জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে রাজনীতিতে ইউটার্ন নেয়।
এ জন্যই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ চান। অবশ্য জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদও ইসিতে চিঠি দিয়ে নৌকা ও লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনের কথা জানান। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি ভোটে আসলে জাতীয় পার্টি আগের মতো আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে মহাজোটের অধীনে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি নির্বাচনে না এলে দলটি নিজেদের পছন্দের ক’টি দলকে নিয়ে নিয়ে নির্বাচন করবে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, যারা বড় দলের সঙ্গে জোটে যেতে চাচ্ছে এবং বড় দলগুলো যাদের জোটে নিতে চাচ্ছে বা নিয়েছে তাদের সবারই লক্ষ্য ভোটে জয়লাভ। এ জন্য নির্বাচনের আগেই জোটের পাল্লা ভারি করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে। এ যেন ভোটের আগে ভোট।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটে থাকা শরিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ(ইনু), সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ(মোজাফফর), গণআজাদী লীগ, বিকল্প ধারা, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাসদ, তরিকত ফেডারেশন এবং জেপি। এই দলগুলো নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবে। অপরদিকে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে গেলে তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে জোট করবে। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াত, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, লেবার পার্টি, মুসলিম লীগ, খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ এবং বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত একাধিক রাজনৈতিক দল মিলে জোট গঠন করে নির্বাচন করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে যে কোনো একটি দলের প্রতীক জোটভুক্ত দলগুলোর প্রার্থীদের বরাদ্দ করা যায়। এমন প্রতীক পেতে হলে জোটভুক্ত শরিক দলগুলোকে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন বরাবর আবেদন দাখিলের বিধান রয়েছে। ১৫ নভেম্বর ইসি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। আর শনিবার ছিল তফসিল ঘোষণার পর ৩ দিনের শেষ দিন। তাই জোটভুক্ত নির্বাচনে আগ্রহী দলগুলো ইসিতে আবেদন করে তা জানিয়েছে।
এ বিষয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সাংবাদিকদের জানান, আমরা ১৪ দলীয় জোটের অধীন নির্বাচন করবো। এ জন্য আমরা নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠিয়েছি।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু জানান, ১৪ দলীয় জোটের অধীন নির্বাচন করতে আমরা নির্বাচন কমিশন ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছি। তাই আশা করি জোটের প্রতীক নৌকা নিয়েই আমরা ভোট করতে পারবো।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, আমাদের দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। সময়মতো সব জানানো হবে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করবে না জোটগতভাবে করবে। আর জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও কোন কোন দলকে জোটে নেয়া হবে তাও সময় মতো জানিয়ে দেয়া হবে।
এস/ভি নিউজ