সুমন ভট্টাচার্য
আমেরিকা কি যে কোনও মুসলিম রাষ্ট্রকেই ইরাক কিংবা প্যালেস্তাইন বানাতে চায়? একদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন, আর অন্যদিকে সেদেশে সহিংস আন্দোলন যারা করছে, যারা রাস্তায় নেমে বাসে আগুন দিচ্ছে, তাদের প্রতি ওয়াশিংটনের সহমর্মিতা দেখলে এমনতর সন্দেহ জাগাটা স্বাভাবিক। আশ্চর্যের বিষয় খোদ হোয়াইট হাউজের সাংবাদিক সম্মেলনেও যেসব প্রশ্ন উঠে আসছে, আমেরিকার বিদেশ দফতরের মুখপাত্ররা যা সব বলছেন তাতে এইরকম ‘প্যালেস্তাইনের মতো পরিস্থিতি’ তৈরি হওয়ার উল্লেখ থাকছে। এর থেকেই সংশয় হচ্ছে এই সব কিছুর পিছনে মার্কিন বিদেশ দফতরের কী পরিকল্পনা রয়েছে। সুখের বিষয় ওয়াশিংটন তার চিরাচরিত ‘ফোঁপর দালালি’র স্বভাব যখন ছাড়তে পারছে না, তখন ভারত, রাশিয়া এবং অন্য বৈদেশিক শক্তিগুলি বাংলাদেশের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরে আস্থা রাখতে চেয়েছে। গোটা পৃথিবীতে যখন আমেরিকার বিদেশ নীতির ব্যর্থতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে, গাজায় রক্তস্নানের জন্য সবাই বাইডেন প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলছে, এমনকি নিউ ইয়র্ক টাইমস পর্যন্ত লিখছে যে, ‘জো বাইডেন-ইহুদি অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন-এর ইজরায়েল নীতি’র প্রতিবাদে ডেমোক্র্যাট দলের নবীন প্রজন্মই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি লিখছে, তখন হোয়াইট হাউজের বিশ্বের আর এক প্রান্তে, আর একটি মুসলিম দেশে ‘ফোঁপর দালালি’ মারার এবং কট্টরপন্থী শক্তিকে উস্কানি দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ইতিহাস বলে এবং এই সাম্প্রতিককালের প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল সংঘর্ষের সময় আবার সেই তথ্য সামনে এসেছে, যে কীভাবে প্যালেস্তাইনের মুক্তিকামী আন্দোলনের জনপ্রিয় নেতা, পিএলও প্রধান ইয়াসের আরাফতকে কোণঠাসা করে কট্টরপন্থী হামাসকে তুলে আনার পিছনে আমেরিকা এবং ইজরায়েলের ষড়যন্ত্র ছিল। অনেকেই সন্দেহ করেন যে, একসময় প্যালেস্তাইনের অবিসংবাদী নেতা ইয়াসের আরাফত, যিনি আমেরিকার দৌত্যেই ইজরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন এবং সার্বভৌম প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনের জন্য ‘অসলো চুক্তি’তে সই করেছিলেন, তাঁকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল। ইয়াসের আরাফতের হত্যা রহস্য আজও সংশয়ে ঢাকা পড়ে রয়েছে, কিন্তু ‘ভারতবন্ধু’, স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র তৈরির স্বপ্ন দেখানো ইয়াসের আরাফতের মৃত্যুর পিছনে কাদের হাত ছিল সেকথা অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রের জনকের হত্যার পিছনে কোন বিদেশি রাষ্ট্রগুলির চক্রান্ত ছিল তাও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে কলকাতা শহরে সাংবাদিক সম্মেলন করে ভারতবর্ষের তৎকালীন শাসকদল কংগ্রেসের নেতারা সরাসরি মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইয়ের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন।
ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতনে, যেমন সেই গত শতকের সাতের দশকে একদিকে যখন আমেরিকা ভিয়েতনাম নামক একটি ছোট রাষ্ট্রের ওপরে বোমা এবং নির্যাতনের প্লাবন বইয়ে দিয়েছিল আর অন্য দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের বিষয়ে নাক গলিয়েছিল, ঠিক তেমনই এবার যখন প্যালেস্তাইনে রক্তের বন্যা বইছে তখনই আবার ঢাকায় ওয়াশিংটনের ‘ফোঁপর দালালি’ চলছে। ‘ফোঁপর দালালি’ শব্দটি মার্কিন বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে সঠিক শব্দ হবে, কারণ বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইরাক নিয়ে কী ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করতে চেয়েছিলেন, তা ইতিহাস ভুলে যায়নি। ইরাক আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর তৎকালীন সিনেটর এবং মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান জো বাইডেন এবং তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সেই দেশকে তিনটি টুকরোতে ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব এনেছিলেন। সৌভাগ্যের বিষয় বাইডেন-ব্লিঙ্কেনের যুগলবন্দিতে তৈরি হওয়া সেই প্রস্তাব আমেরিকার সিনেটই নাকচ করে দিয়েছিল। বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এককালে সমৃদ্ধশালী, মুসলিম ইতিহাস এবং সভ্যতার গৌরবজ্জ্বল পর্বের স্মৃতিকে ধরে রাখা বাগদাদ এবং ইরাক কীভাবে ধ্বংসপুরীতে পরিণত হল, কীভাবে হাজারো হাজারো মুসলিমের প্রাণ গেল এবং আজ ইরাক মানেই কেন হানাহানি, জঙ্গী গোষ্ঠীর তৎপরতা আর প্রাণ হাতে নিয়ে চলা তা আমরা সবাই জানি। সাম্প্রতিককালে প্যালেস্তাইনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরে আবার পশ্চিম এশিয়া এবং আরব দুনিয়ার সবাই মনে করিয়ে দিয়েছেন ইরাক আসলে আমেরিকার ভ্রান্ত বিদেশ নীতির এইরকম একটি জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ হয়ে থাকার পরেও কীভাবে ওয়াশিংটন কোনও শিক্ষা নেয়নি। জো বাইডেন এবং অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনরা যে নিজেদের ভুল থেকে কিছুই শেখেন না, জনপ্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে কলকাঠি নেড়ে অন্য কোনও চরমপন্থী গোষ্ঠীকে মদত দিয়ে আমেরিকা কী ধরনের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে তা আমরা প্যালেস্তাইনে দেখছি, আর বাংলাদেশ নিয়ে কী অভিসন্ধি ছিল তা আন্দাজ করেও শিউরে উঠছি।
সুখের বিষয়, আমেরিকা যখন বাংলাদেশের বিষয়ে এই সব ‘ফোঁপর দালালি’ মারতে চেয়েছে, তখন ভারত সফরে আসা আমেরিকার প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ সচিবকে নয়া দিল্লি সতর্কবাণী শুনিয়ে দিয়েছে। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনদের ভারত সফর এবং জয়শঙ্কর-রাজনাথ সিংদের সঙ্গে ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকের সময় নয়া দিল্লি যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার ভুল নীতি বিষয়ে যথেষ্ট কড়া মন্তব্য করেছে তা ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় কোয়াত্রার সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার। একই সঙ্গে বাংলাদেশে কী হবে সেই নিয়ে আমেরিকার মাথা গলানোর চেষ্টা তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে মস্কো। আর চিন অনেক আগে থেকেই ঢাকায় আমেরিকার ‘দাদাগিরি’ বা নাক গলানোর বিরোধিতা করে বাংলাদেশের নিজস্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখার কথা বলে আসছিল।
সুমন ভট্টাচার্য; সাংবাদিক, কোলকাতা।
এস/ভি নিউজ