বাংলা কাব্যে হেমন্তের রূপ

Share

এস ডি সুব্রত

বাংলা সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব আবেগময় কবিচিত্তের কাব্যিক সুষমার এক অনন্য চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। কবির কল্পনায় রূপ রসে ঋতুচক্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠে এসেছে তাঁদের শিল্প সাহিত্যে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তাই প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য রচয়িতা কবিদের পক্ষে তো নয়ই

বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। ঋতুচক্রের পরিক্রমায় শরতের পরে শূন্যতা, রিক্ততা ও বিষণ্ণতা প্রকৃতিতে আবির্ভূত হয় হেমন্ত ঋতু। শরৎ প্রকৃতির বহু বর্ণিল ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতার আবেশ মানবমনে শিহরণ তোলে না, শিহরণ তোলে হিমসমীরণে অদূরবর্তী তুষরের আগাম বারতা।

হেমন্ত ঋতুতে লক্ষ্মীর শুভাশিসে রাশি রাশি ভারা ভারা কনক আভাময় পাকা ধান মাঠে মাঠে শোভা পেতে থাকে। প্রখর তাপদাহ উপেক্ষা করে যে কৃষক ফলিয়েছে সোনাবরণ ধান, ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে তার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তির নির্মল আনন্দ হাসি গান। প্রকৃতির এই যে কল্যাণময়ী রূপশ্রী, অকাতরে অন্নের সংস্থান বঙ্গবাসীকে প্রাচুর্যময়ী হেমন্ত লক্ষ্মীর অকৃপণ দান যেন। হেমন্তের নতুন ফসলের ঘ্রান কৃষাণ কৃষাণির বুকে জাগায় নতুন স্বপ্নের দিশা। জাগায় নতুন প্রাণের স্পন্দন।

বাংলা সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব আবেগময় কবিচিত্তের কাব্যিক সুষমার এক অনন্য চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। কবির কল্পনায় রূপ রসে ঋতুচক্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি সজীব হয়ে উঠে এসেছে তাঁদের শিল্প সাহিত্যে। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তাই প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য রচয়িতা কবিদের পক্ষে তো নয়ই। তাই তাঁদের রচনায় প্রকৃতি একটি বড় অনুষঙ্গ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতের প্রভাব দীর্ঘ হলেও হেমন্তের প্রভাব একেবারে কম নয়। ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, নির্মল পরিতৃপ্তি ও আসন্ন শীত ঋতুর আগমনী বার্তাবহ। কবি সাহিত্যিক তাঁদের সুনিপুণ হাতের জাদু স্পর্শে শৈল্পিক সৌন্দর্যের আবেশে হেমন্ত অনবদ্য বাণীমূর্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। সাহিত্যের প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচিত চর্যাপদে কোনো ঋতুরই উপস্থিতি নেই। তবে মধ্যযুগের কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের সামান্য নমুনা দৃষ্টিগোচর হয়। কবির ভাষায়-

‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ

যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’

মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলিতে হেমন্তের নতুন ধান্যে কৃষকের ঘরে ঘরে সুখের আবেশ ছড়ায়। এ সময়ে তারা পরম তৃপ্তিতে সুখস্মৃতি নিয়ে আনন্দ বিলাসে মেতে ওঠে। বৈষ্ণব পদকর্তা লোচনদাসের পদে তার সমর্থন প্রবলভাবে প্রকাশ হয়েছে এভাবে-

‘অগ্রাণে নোতুন ধান্য বিলাসে।

সর্বসুখ ঘরে প্রভু কি কাজ সন্ন্যাসে

পাটনেত ফোটে ভোটে শয়ন কম্বলে।

সুখে নিদ্রা যাও তুমি আমি পদ তলে’

গোবিন্দদাসের রচিত পদে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। অঘ্রাণে কৃষাণ

-কৃষাণির সমৃদ্ধি ও সুখের সময়ে কুলবধূরা স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে নায়রে গমন করে। তার রচিত পদে উল্লিখিত হয়েছে-

‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র

নায়র মাথুরা গেল।

পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ

বৃন্দাবন বন ভেল’

কৃষকের জীবনাচরণ আধুনিক বাংলা কাব্যের একটি বড় অনুষঙ্গ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ কারণে এ দেশের প্রায় সকল কবিই সাহিত্যিকের রচনায় কোনো না কোনোভাবে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্ত ঋতু নিয়ে অজস্র কবিতা ও গান রচনা করেছেন। বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীম উদ্দীন, সুফিয়া কামাল, সুধীন দত্ত, বিষ্ণুদে, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কাব্যে হেমন্ত ঋতু অসাধারণ চিত্রকল্পে পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

রবি ঠাকুরের আত্মদর্শন ও ভাববাদী চিন্তা চেতনায় অন্তর্লোকে পরমাত্মার স্পর্শে হেমন্ত মূর্ত হয়ে উঠেছে নিরালোকের ভাব ও ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতিতে। তাঁর অসংখ্য গান ও কবিতায় হৈমন্তিক বিশিষ্টতা ধরা পড়ে। তাঁর কাছে হেমন্ত নিঃশব্দ গতিহীন স্তবতা এবং অবারিত শান্তির প্রতীক। কবিগুরুর কবিতায় হেমন্ত বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে

জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে

শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার

রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার

স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত শিশির ভেজা হিমেল হাওয়ার শিশির অনুভূতি এবং তীর্যক কাঁচা রোদের উষ্ণ পরশ।

‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া

সেই নাচনে উঠল মেতে।

টইটুম্বুর ঝিলের জলে

ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে

চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে

সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’

তাঁর ‘অঘ্রাণের সওগাত’ কবিতার হেমন্তের আবির্ভাব ঘটে ধরণীতে আশীর্বাদের বার্তা নিয়ে। এ সময়ে গ্রাম বাংলা নতুন ধানের নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। বাড়িতে বাড়িতে চলে ফিরনি, পায়েশ ও পিঠা তৈরির ধুম।

‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত।

নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।

গিন্নি পাগল চালের ফিরনি

তশতরী ভরে নবীনা গিন্নী

হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীদের খুশিতে কাঁপিছে হাত।

 শিরনি বাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেস্মাত।

হেমন্ত প্রকৃতিতে গ্রামীণ জীবনের নিখুঁত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে পল্লী­কবি খ্যাত জসীম উদ্দীনের কবিতায়। এ সময়ে মাঠে মাঠে পড়ে থাকে হলুদ পাকা ধান। কৃষাণ-কৃষাণির ব্যস্ততা পাকা ধান ঘরে তোলার। পাকা ধানের ম-ম গন্ধ ছড়ায় চারদিকে।

সুখের বাসর কবিতায় মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এভাবে-

‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান,

সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান।

ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু

কলমি লতায় দোলন লেগেছে, ফুরাল ফুলে আয়ু।’

হেমন্ত তাঁর প্রিয় ঋতু। অপূর্ব কাব্যিক সুষমায় হেমন্ত তাঁর তুলির আঁচড়ে বাঙময় রূপে ধরা দিয়েছে। আর কোনো কবির কাব্যে হেমন্ত তাঁর মতো রূপক, উপমা অলংকার, নব নব শব্দের বিনুনিতে এতো অনবদ্য প্রকাশ চোখে পড়ে না। ‘হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ’ প্রবন্ধে নরেশ গুপ্ত লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই।’

কবি হেমন্তকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বিকেলের নরম হলুদ রঙের বর্ণবৈভবহীনতা এবং বিরাণ শূন্য প্রান্তরের বিবর্ণতা।

‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শূন্যতা রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা, ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি তাই তার ঘুম পায়-ক্ষেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনই সে ক্ষেতের ভিতর এখনই সে নেই যেন ঝড় পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণœ সোনালি।’

——‘অঘ্রাণ’ ‘জীবনানন্দের অপ্রকাশিত কবিতা’

গ্রাম বাংলার অনবদ্য রূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ কবি সুফিয়া কামাল। পল্লী প্রকৃতির সহজ সরল ও স্বাভাবিক রূপ তাঁর কাব্যে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। গভীর মমতায় ও ভালোবাসায় প্রকৃতি তাঁর অন্তরঙ্গ অনুভবের সংশ্লিষ্টতায় অপূর্ব সৌন্দর্যে আবিভূত হয়েছে পল্লী-বাংলার পরতে পরতে।

‘হেমন্তের কবি আমি, হিমাচ্ছন্ন ধূসর সন্ধ্যায়

গৈরিক উত্তরীয় টানি মিশাইয়া রহি কুয়াশায়।’

—‘মন ও জীবন’

আবার কখনো তিনি হেমন্তকে চিঠি লিখে বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে আবিভূত হওয়ার আহ্বান ও জানিয়েছেন।

‘সবুজ পাতার খামের ভেতর

হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে

কোনো পাথারের ওপার থেকে

আনল ডেকে হেমন্তকে?

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় প্রকৃতির রিক্ততা ও শূন্যতার চিত্রকল্পে হেমন্তের শাশ্বত নীরব ও বিষণœতার চিত্রই ফুটে ওঠে।

  ‘ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্ত লোহিত

  তরুণ তরুণী শূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,

  শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ, নিশাক্রান্ত বিষণœ বলাকা

ম্লান চেতনারে মোর আকস্মাৎ করেছে মোহিত

হেমন্ত বুদ্ধদেব বসুর তীক্ষè চৈতন্যেকে আনন্দে উদ্বেলিত করে না, তাঁর বিষণœ মনে হেমন্ত আর দোলা দিয়ে ওঠে না।

‘পউষে ফাল্গুন গাঁথা কান্না-হাসি দোলানো অন্যায়

আমাকে বেঁধে না আর, বড়ো জোর রাত, পিত্ত, শ্লেষ্মার সংবিৎ এঁকে যায় যায় সামান্য গণিত চিহ্নে পঞ্জিকার পালা’। পল্লী বাংলার লোকায়িত জীবন ও তার শ্যামল রূপ ঐশ্বর্য আল মাহমুদের কবিতায় ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রকৃতি কখন কখন দেহজ কামনা বাসনায় অপূর্ব নারী মূর্তি রূপে আকর্ষণ করেছে সান্নিধ্য পাওয়ার আকাক্সক্ষায়।

‘আজ এই হেমন্তের জলজ বাতাসে

আমার হৃদয় মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে

রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে

আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর

বসায় মার্চের দাগ, লাল কালো কট ও কষায়।’

(…অঘ্রাণ)

হেমন্তের আগমনে গ্রামীণ পল্লী জীবনে কৃষাণ কৃষাণির মুখশ্রীতে আনন্দের ঝিলিক খেলে যায়। 

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় গ্রামীণ প্রকৃতির চিরাচরিত স্বাভাবিক রূপটিই উন্মোচিত করেছেন।

‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ঘুরতে দেখেছি অনেক।

তাদের হলুদ ঝুলি ভরে গিয়েছিল ঘাসে আবিল ভেড়ার পেটের মতন

কতকালের পুরনো নতুন চিঠি কুড়িয়ে পেয়েছে

তাই হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যানগুলি

আমি দেখেছি কেবল অনবরত ওরা খুঁটে চলেছে

বকের মতো নিভৃত মাছ।’

——(হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান।)

 হেমন্ত প্রকৃতির বৈচিত্র্যে এদেশের অসংখ্য কবি সাহিত্যিক বিস্তর মুগ্ধচিত্ত না হলেও অনেকেই এ প্রকৃতি নিয়ে কবিতা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। সৃজনশীল কবি হৃদয় এ বিষণ্ণ উদাসীন প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ মধুর কাব্যিক উপমায় হেমন্তকে তুলে ধরেছেন মমতাময়ী নারীর সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতাকে। আধুনিককালের প্রায় সকল কবির রচনাতেই কোনো না কোনোভাবে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ বিদ্যমান রয়েছে। উপমা রূপক উৎপেক্ষা ও অলংকারে হেমন্ত ঋতু কবি হৃদয়ের সংশ্লিষ্টতায় অনবদ্য ও নান্দনিকতায় আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে অনন্য বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপিত হয়েছে এ কথা অকপটে স্বীকার না করার কোনো কারণ নেই।

এস/ভি নিউজ