সাইবার নিরাপত্তা আইনেও শিশু সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেই

Share

বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছে শিশুরাও। আইনটি কার্যকর করার পর থেকে বেশকিছু শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের বেশির ভাগের বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৭ বছর।

শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে হওয়া অধিকাংশ মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া) পোস্ট, কমেন্ট বা শেয়ার করার কারণে অভিযুক্ত হয়েছে তারা। শিশু আইন অনুযায়ী, এ বয়সীদের বিচার শিশু আদালতে হওয়ার কথা। অন্য যে কোনো আইনে অভিযুক্ত হলে এ সুযোগ পায় শিশু। হাইকোর্টের একাধিক রায়েও এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশু আদালতকে প্রাধান্য দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় শিশুদের বিচার করা হয় প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের মতো ট্রাইব্যুনালে। কারও কারও মামলার বিচার এখনো চলছে। কেউ কেউ জামিনে আছে।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও শিশুদের বিচারের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বিধান রাখা হয়নি। এমনকি সাইবার অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে এ আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল ও ফৌজদারি আইনের বিধানের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নতুন আইনেও শিশুদের বিচারিক হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাওয়া হলে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘শিশুদের ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কাটা থেকেই যাচ্ছে। আইনের ব্যাখ্যা না জানার কারণে শিশুদের বিচার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

মালিক বলেন, ‘আইন তিন ধরনের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ আইন হচ্ছে সংবিধানের নির্দেশ বাস্তবায়নে যেসব আইন এবং তৃতীয় হচ্ছে সাধারণ আইন। শিশু আইনটি শিশুদের বিশেষ অধিকার বাস্তবায়নের জন্য করা। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে করা হয়। যার কারণে অন্য কোনো সাধারণ আইনের ক্ষমতা নেই শিশু আইনকে অকার্যকর করা। যার কারণে শিশুদের বিচার একমাত্র শিশু আদালতেই হবে। আইনের এ ব্যাখ্যা সবাই জানে না। তার পরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইনেও এ অপব্যবহারটার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।’

জানা যায়, ২০১৮ সালে পাস হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আইন পাসের পর থেকেই এর অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার অভিযোগে সাংবাদিক, দেশে-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন আইনটি বাতিলের দাবি তোলে। এক পর্যায়ে সরকার গত ৭ আগস্ট ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার সিদ্ধান্ত নেয়। খসড়া আইনটি এরই মধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই পাস হওয়ার কথা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটের সহজগম্যতায় শিশুরা ঝুঁকছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। অনেক শিশু জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে।

বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১ হাজার ২৮১ শিক্ষার্থীর ওপর একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করে ইউনিসেফ। স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসাগামী এসব শিক্ষার্থীর বয়স ছিল ১০ থেকে ১৭ বছর। জরিপে অংশ নেওয়া ২৫ শতাংশ শিশু ১১ বছর বয়সের আগেই ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শিশুরা ইন্টারনেটে সবচেয়ে বেশি যে দুটি কাজ করে, তা হচ্ছে অনলাইন চ্যাটিং (বার্তা আদান-প্রদান) ও ভিডিও দেখা।

জরিপে উঠে এসেছে, ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে। ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইনে সাইবার বুলিং, সহিংসতা, ভয়ভীতি ও উৎপীড়নের শিকার হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য অযোগ্য ভিডিও, ইমেজসহ বিভিন্ন বিষয় দেখে সময় কাটাচ্ছে বলেও গবেষণায় উঠে আসে। এসবের প্রভাবে অনেক শিশু সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এ ধরনের অপরাধে কোনো শিশু অভিযুক্ত হলে তার বিচার কীভাবে হবে—নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বিধানও রাখা হয়নি।

প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪৮ ধারায় এ আইনের অধীনে করা অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই ধারার উপধারা-১-এ বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধসমূহ কেবল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার্য হইবে।’

আইনের ৪৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে ভিন্নরূপ কোনো বিধান না থাকিলে, কোনো অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ও অন্যান্য বিষয়াদি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানাবলি প্রযোজ্য হইবে।’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বলেন, ‘শিশু আইনেই শিশুদের বিচার হওয়ার কথা। এটা সুনির্দিষ্ট করা আছে। অপব্যবহার হলে তা আদালতের নজরে আনতে হবে। এজন্য সাইবার নিরাপত্তা আইনে এটা স্পষ্ট করার দরকার নেই বলে আমি মনে করি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিচার করবে একমাত্র শিশু আদালত। আইনের ২ (৩) ধারা অনুযায়ী, ‘আইনের সহিত সংঘাতে জড়িত শিশু অর্থ এমন কোন শিশু যে, দণ্ডবিধির ধারা ৮২ ও ৮৩ এ বিধান সাপেক্ষে, বিদ্যমান কোন আইনের অধীন কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত এবং ২ (৪) ধারা অনুযায়ী আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু অর্থ শিশু বলতে বিদ্যমান যে কোন আইনের অধীনে কোন অপরাধের শিকার বা সাক্ষীকে বোঝাবে।’

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু আদালতের বাইরে শিশুদের বিচার করা শিশু আইন ও হাইকোর্টের রায়েরও লঙ্ঘন। হাইকোর্টের ‘রাষ্ট্র বনাম রওশন মণ্ডল মামলার (২০০৭; ৫৯ ডিএলআর ৭২)’ রায়ে বলা হয়েছে, ‘অপরাধের বিচারের এখতিয়ার একটি গৌণ বিবেচনা, প্রথম বিবেচনা হচ্ছে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে বিচারের এখতিয়ার। যখন ব্যক্তির ওপর এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন শিশুর বিচার করার ক্ষমতা শিশু আদালত ছাড়া অন্য কোনো আদালতের থাকে না।’

আবার মো. আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলার (১৫ এসসিওবি; ২০২১; এইচসিডি) রায়ে বলা হয়েছে, ‘১৯৭৪ সালের শিশু আইনের অধীনে শিশু আদালত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখন শিশু আইন-২০১৩-এর অধীনে গঠিত একটি শিশু আদালত মামলাগুলোর বিচার করার জন্য একচেটিয়া এখতিয়ার পেয়েছে। যেখানে আইনের সংঘাতে আসা শিশুদের ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। শিশু আদালতের এখতিয়ার স্পষ্টভাবে বাদ দেওয়া না হলে আইনের বয়স বিবেচনায় কোনো বিশেষ বা সাধারণ আইনের অধীনে গঠিত কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালের এ ধরনের মামলার বিচার করার এখতিয়ার নেই।

কিন্তু আইন এবং হাইকোর্টের এসব নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে শিশুদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক মামলা হয়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত শিশুর সংখ্যা ২৬। আর এই আইনে আটক হযেছে ২১ শিশু।

অন্যদিকে ২০২০ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় ৬৮ শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩৪টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দৃক। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, মামলা হওয়া শিশুদের অধিকাংশই জামিনে আছে। আবার অনেকে ১ থেকে দেড় বছর ধরে বিভিন্ন শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে আছে। তবে মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন আছে।

দৃকের তথ্যমতে, এসব মামলায় অভিযুক্তদের অধিকাংশের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর। কারও কারও মামলা হওয়ার সময় বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৪ বছর।

আইনজীবীদের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। শিশুদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইন প্রয়োগ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিরুদ্ধে ডিএসএ প্রয়োগের ফলে শিশু আইনেরও ব্যত্যয় ঘটছে।

শিশুদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা দায়েরের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে গত বছরের আগস্টে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি পাঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের বয়স বেশি দেখিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত মামলা দায়েরের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এর মাধ্যমে শিশু আইন ২০১৩-এর বিধানাবলি সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে।’

এস/ভি নিউজ