২০ থেকে ২২ মে জি২০ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরে। কয়েক দশক ধরে আমরা ভারতের এই রাজ্যটিকে সবচেয়ে অস্থির এবং সহিংস রাজ্য মনে করে আসছি; অন্তত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আমাদের যেভাবে পড়িয়েছে। ভারত সরকার সেখানেই জি২০ ট্যুরিজম ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেন?
এই ‘কেন’ ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক বড় পরিসর প্রয়োজন। তবুও সারসংক্ষেপ বলা যেতে পারে। পাকিস্তানের আপত্তি সত্ত্বেও জি২০ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ভারতের জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করতে যাচ্ছে বলেই ভারতের সরকার মনে করছে। তারা মনে করছেন, শুধু অর্থনীতিই নয়, এটি ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই ভাবনায় দোষের কিছু দেখছি না। খোদ কাশ্মীরের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে।’ উল্লেখ্য, জি২০ ফোরামের বর্তমান সভাপতি হিসেবে ভারত ৫৫টি স্থানে ২১৫টি মিটিংয়ের পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে অন্তত চারটি মিটিংয়ে ট্যুরিজমের ওপর আলোকপাত করা হবে। কাশ্মীর অবশ্যই ভারতের ট্যুরিজমের অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। যদি ইতিবাচক দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখা যায় তা হলে এটাও দেখা যেতে পারে যে, গোটা ভারত যে সময়টায় তপ্ত হয়ে থাকে, গরমে মানুষের সর্বোচ্চ কষ্ট হয়, তখন কাশ্মীরে চমৎকার ফুরফুরে হাওয়া বিরাজ করে। চারদিক ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। তাই ভেন্যু হিসেবে কাশ্মীরকে বেছে নেওয়ার মধ্যে সমালোচনার কী আছে তা মোটেই বোধগম্য নয়।
এই তো মাত্র ২০১৯ সালে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৩৫/এ বাতিল করে দেয়। বাস্তবতা অনুধাবন করতে হয়। রাজ্য সরকারের মধ্যে যখন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পুরোপুরি আশ্রয় খুঁজে পায়, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আর কোনো উপায় থাকে না। ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটেছে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে। এই বাতিলের পক্ষে যারা বিজেপি সরকারের সঙ্গে পার্লামেন্টে সম্মতি দিয়েছেন, তারাও এখন এ বিষয়ে ভারতে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করেন। রাজনীতি এমনই এক মারপ্যাঁচের বিষয়।
যাহোক ২০১৯ সালের পর এটাই কাশ্মীরে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক মিলনমেলার আয়োজন। এখানে চীন অংশ না নিলেও বিভিন্ন দেশের কমপক্ষে ৫০ জন প্রতিনিধি অংশ নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ভারত সরকারও মনে করছে, জি২০’র এই সর্বোচ্চ ফোরামে তারা এটা দেখাতে পারবে যে, কাশ্মীরের পরিস্থিতি মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সত্য বলার অনেক বিড়ম্বনা। এ দেশে যারা ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন, তারা বিচার-বিশ্লেষণ না করে এক কথায় বলে দেবেন ‘ভারতের দালালি’। অথচ বিষয়টি মোটেও তা নয়। সব বিষয়ে সত্য অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করাই শ্রেয়। ভারত সরকার কাশ্মীরে সম্মেলনের ব্যাপারে যে মনোভাব পোষণ করছে তাতে অসত্যতা নেই। অথচ মিটিং সামনে রেখে ১৫ মে জাতিসংঘ বিশেষ প্রতিবেদকের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তা কতটা সঠিক এবং কেন তারা এমন প্রতিবেদন দিয়েছে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রতিবেদক ফারনান্ড দ্য ভ্যারেনেস তার প্রতিবেদনে মোটামুটি এ রকম বলেছেন, ‘ভারত সবকিছু স্বাভাবিক বোঝাতে চাইছে এবং একটি আন্তর্জাতিক অনুমোদন চাইছে কাশ্মীরে সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।’ তিনি তার প্রতিবেদনে দাবি করেছেন যে, ‘কাশ্মীরে মৌলিক অধিকার দমন করা হচ্ছে।’ তার এ প্রতিবেদনে অনেক অতিরঞ্জন আছে। কারণ তারাও একটি পক্ষ। এটা অনুমান করতে আমাদের মোটেই কষ্ট হয় না যে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কটি এখন উষ্ণ নয়, বলা যায় অম্লমধুর। অম্ল রাশিয়া প্রশ্নে এবং নানা বাণিজ্য প্রতিযোগিতার কারণে, জ্বালানি ও সামরিক ক্রয়-বিক্রয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুদেশের পররাষ্ট্রনীতির কারণে। আবার দুপক্ষেরই যার যার স্বার্থে কোয়াডসহ এ অঞ্চলের আধিপত্যের প্রশ্নে সমঝোতা রয়েছে, ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলতে হচ্ছে; সামরিক মহড়া অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একটি ধারণা বদ্ধমূল আছে যে, ভারতকে সব কথা শোনানো যায় না। তাই কোনো কোনো বিষয়ে ভারতকে একটু চাপে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। এটা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে, বিশ্বের নামিদামি মিডিয়া হোক আর জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোই হোক, তার সবই যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে! তাই কর্তা যা চাইবেন, প্রতিবেদন আকারে তাই প্রকাশ হবে। এসব প্রতিবেদনকে বেদবাক্য মনে করলে মস্ত ভুল হয়ে যাবে।
সত্য বলতে গেলে অনেকে হয়তো বলবেন ভারতের দালালি করে। কিন্তু না, সত্য তো সত্যই, তা যে যাই ভাবুক। আমি সদ্যই কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ফিরেছি। দেখতে গিয়েছিলাম আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা শ্রীনগরে কেমন আছে। রাজধানীই তো সারাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে। যত্রতত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাতে আগের ধারণা পাল্টে গেছে। মানুষের মধ্যে জি২০ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখতে পেয়েছি। এ বছর কাশ্মীরের জনগণ ইতিহাসের সর্বোচ্চসংখ্যক ট্যুরিস্ট প্রবেশের আশা করছে। কাশ্মীর এখন সত্যিকার বিদেশি বিনিয়োগের মুখে। পৃথিবীর কোনো দেশই অথবা কোনো দেশের ব্যবসায়ী অস্থিরতা আছে এমন কোথাও আর যাই করুক, বিনিয়োগ করে না। ঝুঁকি নেয় না। ইসলামের অন্যতম পীঠস্থান দুবাইয়ের ইমার গ্রুপ ইতোমধ্যেই কাশ্মীরে ৬০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই ইমার গ্রুপ কোনো বোকাসোকা প্রতিষ্ঠান নয়। এই গ্রুপেরই কোম্পানি ইমার বিল্ডার দুবাইতে অবস্থিত ভুবন বিখ্যাত বুর্জ খলিফা বিল্ডিংয়ের নির্মাতা। ২০২২-২৩ সালে ইতোমধ্যে ১৫ বিলিয়ন রুপি বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরে।
হ্যাঁ কাশ্মীরে সন্ত্রাস ছিল। এখনো সন্ত্রাসবাদীরা যে নিভে গেছে তা নয়। কিন্তু পাকিস্তান দিনে দিনে যত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে এবং পাকিস্তান মিলিটারি রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে পড়েছে, ততই কাশ্মীরে সন্ত্রাস কমেছে। জাতিসংঘ বা পশ্চিমা বিশ্ব কী চায়? যে উপত্যকায় লস্কর-ই-তৈয়বা, হরকাতুল মুজাহিদীন, আল জিহাদ, তেহেরিক-উল-মুজাহিদিন, হিজবুল মুজাহিদিনের মতো নটরিয়াস সংগঠনগুলো বিদ্যমান, সেখানে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান কি সরকারের দায়িত্ব নয়? জাতিসংঘের রিপোর্ট পড়ে মনে হয়েছে তারা জিহাদিদের কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে! অনেকটাই যেন সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশ্রণের অপপ্রয়াস। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের অনেকের মধ্যে অসন্তোষ আছে, যেমন অসন্তোষ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান অথবা স্পেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকায় আছে। কিন্তু জাতিসংঘ বা পাকিস্তান যেভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি উপস্থাপন করছে তা মোটেই বর্তমান কাশ্মীরের প্রতিচ্ছবি নয়। এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। কাশ্মীরে ভারত সরকার লাখ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে, নারী ক্ষমতায়নে, বেকরত্ব দূরীকরণে। আপনি শ্রীনগর যান, সেখানে দেখতে পাবেন নারী-পুরুষ পাশাপাশি হাটবাজার করছে, চাকরি করছে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে পাশাপাশি বসে যাতায়াত করছে। সেই সঙ্গে একটু খোঁজ নিন, যে পাকিস্তান জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ফোরামে নালিশ করছে, সেই পাকিস্তানের দখলিকৃত কাশ্মীরের জনগণের জীবনযাত্রার পরিস্থিতি কী! তাই কোনো কিছুতে অন্ধ বিশ্বাস নয়, সত্যকে অনুধাবন করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। সফল হোক কাশ্মীরের জি২০ সম্মেলন, শান্তিপূর্ণ হোক কাশ্মীরিদের জীবন, আরও উন্নত হোক কাশ্মীরের মানুষের জীবনমান। মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের চাওয়া।
মহসীন হাবিব : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক