পি আর প্ল্যাসিড :
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সরকারের আমন্ত্রণে জাপান সফর করেন। সরকারের নীতিনির্ধারণকারীরা বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি ছিল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সফর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত জাপান একটি পরীক্ষিত বন্ধু দেশ। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি জাপান সরকার এবং দেশটির জনসাধারণের ভালোবাসা অকৃত্রিম ও অফুরান।
স্বাধীনতার পর জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিপাক্ষিক কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা; অতঃপর চুক্তি সম্পাদন করতেই জাপান এসেছিলেন। তার জাপানে এবার ৩ দিনের সফর সফল হয়েছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রীকে জাপান সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আপ্যায়ন করেছে। এতেই ধারণা করা যায়, জাপান আমাদের দেশকে বা সরকারপ্রধানকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে। এবারের সফরে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আটটি বিষয়ে চুক্তি সম্পাদিত হয়, যা আগে কোনো সরকারের সময়কালে সম্পাদিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
প্রধানমন্ত্রীর অল্পদিনের এ সফরে নানা বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন আমাদের জন্য সুখের খবর বয়ে আনলেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে জাপান একটি উল্লেখযোগ্য দেশ হলেও আমাদের দেশে বিনিয়োগে তাদের দৃষ্টি অনেক পিছিয়ে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর ক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এজন্য অবশ্য দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধান, জাপানে তাদের দূতাবাস কর্মকর্তা, সর্বোপরি জাপানে বসবাসকারী সেসব দেশের জনগণ তথা ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে যারা ব্যবসা করতে আগ্রহী এবং দেশপ্রেমী প্রবাসী, যাদের মধ্যে দেশের উন্নয়নের চিন্তাভাবনা রয়েছে, তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ও চেষ্টা বা আগ্রহেই জাপানের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেসব দেশে বিনিয়োগ করে তাদের দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে সহায়ক হয়েছে। তাদের সঙ্গে তুলনা করলে আমার জানামতে বাংলাদেশ সরকারের বা দূতাবাসে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যা করা দরকার, তা তারা সঠিকভাবে করছেন না। জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা তো এ ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে।
তাদের অনেকেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে জাপানে নানা কাজে সময় দেন বেশি। দেখে মনে হয়, তাদের কাছে দেশের চেয়ে দল বড়, তার চেয়ে বড় নিজের পকেট। এ কারণে এত বড় বিনিয়োগকারী দেশে বসবাস করেও সফলতার সঙ্গে নিজেরা দেশের জন্য তেমন কিছু করতে পারছেন না। এমনকি জাপানের ব্যবসায়ীদেরও দেশে বিনিয়োগে ততটা আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ তারা।
এমন এক দেশে থেকে তারা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে জাপানি ব্যবসায়ী বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে পারেননি। যে কটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়েছে, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেরাই গিয়েছে। তবে এটিও ঠিক যে, বাংলাদেশে কাজ করে তাদের অধিকাংশের কাজের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে নানা ধরনের খারাপ অভিজ্ঞতা।
কেউ কেউ দেশে কাজ করতে গিয়ে তাদের মূলধন ফেলে চলে এসেছেন। যদিও এর ব্যতিক্রমও আছে, তবে আমাদের দেশকে ভালোবেসে বিনিয়োগ করতে গিয়ে নানা কারণে ব্যবসা গুটিয়ে সব ফেলে রেখে চলে আসাদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। উচিত ছিল এদের কোনোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং পরামর্শ দিয়ে বিনিয়োগে ধরে রাখা।
এ কাজটি জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের দ্বারাই সম্ভব ছিল, কিন্তু তারা তা করেননি। তাদের দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে জাপানি ব্যবসায়ী বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে না পারার পেছনে কিছু কারণ অবশ্যই রয়েছে। সেসব খুঁজে বের করা আবশ্যক।
গত প্রায় দুই দশক আগে জাপান প্রবাসী কিছু ব্যবসায়ী দেশের সঙ্গে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে এবং জাপানি বিনিয়োগকারীদের দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তোলার মানসে সংগঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, পদের লোভে তাদের কতিপয় ব্যবসায়ীর বিতর্কিত ভূমিকার কারণে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। এর সূত্র ধরেই পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে গঠিত হয় বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ইন জাপান।
এখানেও দেশের রাজনীতির প্রভাব আর পদের লোভ কাজ করায় সংগঠনটি আলোর মুখ দেখেনি বা ভালো কোনো কাজ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে নীতিগত কারণে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সংগঠনটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। বলে রাখা ভালো, এখানে সুবিধাভোগী হন টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের তখনকার রাষ্ট্রদূত; যা দেশপ্রেমীদের কাছে মোটেই কাম্য ছিল না। এমনটা না হলে ওই সংগঠন দেশে জাপানি বিনিয়োগে আগ্রহী অনেক প্রতিষ্ঠানকেই নিয়ে যেতে বা আগ্রহী করে তুলতে পারত।
দীর্ঘদিন বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ইন জাপান নামের সংগঠনটি ঘুমন্ত থাকলেও এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরকালে সফরসঙ্গী হিসাবে তার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের উপস্থিতিতে এবং এরিসা লিমিটেডের কর্ণধার ড. মাসুদ খানের মধ্যস্থতায় ওই ব্যবসায়ীদের দুটি গ্রুপ একসঙ্গে বসে নানা বিষয়ে আলোচনা করে।
সবকিছু আলোচনা করার পর দুই গ্রুপ এক হয়ে দেশের কথা ভেবে নতুন করে আবার কাজ করতে সম্মত হয়। পুরো জাপানে বাঙালি কমিউনিটিতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে করছি, যা দেশে আগের চেয়ে অনেক বেশি জাপানি বিনিয়োগকারী যেতে সহায়ক হবে।
পি আর প্ল্যাসিড : জাপান প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক