আইএজিএসের প্রস্তাবের পর একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতির দাবি লন্ডনেও

343

 

ভিনিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা যাতে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়, সেই প্রয়াসে আরও এক ধাপ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো। সোমবার (২৪ এপ্রিল) ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারস (আইএজিএস) এই মর্মে প্রস্তাব গ্রহণের ঠিক পর দিনই (মঙ্গলবার) লন্ডনের সুপরিচিত ইউনিভার্সিটি সোয়াসের এক আলোচনাচক্রে দেশ-বিদেশের রাজনীতিক-অধিকারকর্মী-গবেষকরাও ঠিক একই দাবি জানালেন।

লন্ডনের মাটিতে বাংলাদেশের ‘জেনোসাইডে’র স্বীকৃতির দাবি সব সময়ই আলাদা তাৎপর্য বহন করে – কারণ একাত্তরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবেই প্রথম বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল।

সোয়াসের আলোচনাচক্রে বক্তারা মনে করিয়ে দেন, ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যিনি ফরেন অ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, সেই পিটার শোর এমপি প্রথম বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি বর্বরতার কঠোর নিন্দা করে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এরপর মোট ২৩৩জন ব্রিটিশ এমপি বাংলাদেশে সংঘটিত ‘জেনোসাইডে’র অবসানের ডাক দিয়ে আর দ্বিতীয় আরেকটি প্রস্তাব আনেন, তাতে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানানো হয়।

ফলে একাত্তরের ‘জেনোসাইডে’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে ব্রিটেন আজও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই সপ্তাহেই আইএজিএস বিপুল ভোটে এই সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করেছে, বাংলাদেশ সরকার তারপর বলেছে জাতিসংঘে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তা অনেকটা এগিয়ে দেবে। ঠিক এর পরপরই লন্ডনের আলোচনাচক্র সেই প্রচেষ্টাতেই বাড়তি গতি সঞ্চার করবে।

‘সোয়াস’ বা স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন) সেমিনার হলে মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় এই আলোচনাসভা বা সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশি ফোরাম (ইবিএফ)। আলোচনার শিরোনাম ছিল ‘রিকগনাইজিং বাংলাদেশে জেনোসাইড ১৯৭১’।

ইবিএফ-এর যুক্তরাজ্য চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট আনসার আহমদউল্লাহ এই সিম্পোসিয়ামে সভাপতিত্ব করেন। আলোচকদের প্যানেলে ছিলেন সিনিয়র ব্রিটিশ সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, নেদারল্যান্ডসের সাবেক এমপি হ্যারি ভ্যান বমেল, জার্মানির সুপরিচিত মানবাধিকারকর্মী ক্লডিয়া ওয়ালডিচ, বেলজিয়ামের শিক্ষাবিদ ও গবেষক উইলেম ভ্যান ডার জিস্ট, সোয়াস সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো চার্লস ওয়ালেস, ইরানি-বালোচ মানবাধিকার কর্মী রোজা হোসেইনবোর, স্বাধীনতা ট্রাস্ট ইউকে-র নির্বাহী সদস্য ভ্যাল হার্ডিং প্রমুখ।

বেলজিয়ামের ডিআরসি গ্লোবালের অধ্যাপক (ড.) তাজিন এম মুর্শিদ, ঢাকার নিউ এজ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক সৈয়দ বদরুল আহসান, ইবিএফ নেদারল্যান্ডস চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়াও সভায় তাদের বক্তব্য পেশ করেন। উপস্থিত ছিলেন লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত কূটনীতিক শেখ মহম্মদ শাহরিয়ার মোশাররফও।

সভায় প্রায় সব বিদেশি বক্তাই এক সুরে বলেন, বাংলাদেশে একাত্তরের জেনোসাইড ঐতিহাসিক সত্য এবং সব দিক থেকে প্রমাণিত – কিন্তু পরবর্তী ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শীতল যুদ্ধের কারণেই তা আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। পাকিস্তানও গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে লাগাতার প্রচার চালিয়ে এসেছে যে একাত্তরের নির্যাতনের বিষয়টি অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ও অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়। এর ফলেই একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতার শিকার লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি বা তাদের পরিবার আজও যথাযথ বিচার পাননি।

বিখ্যাত বাংলাদেশি কূটনীতিবিদ খান সারওয়ার মুর্শিদ ও সাবেক এমপি নূরজাহান বেগমের কন্যা তানজিন এম মুর্শিদ এখন বেলজিয়ামের একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। একাত্তরে তাকেও পাকিস্তানি নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

সোয়াসের আলোচনাসভায় তানজিন এম মুর্শিদ বলেন, ‘পাকিস্তানি বর্বরতার জবাব দিতেই কিন্তু বাংলাদেশিরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। ফলে সশস্ত্র প্রতিরোধ আর গণহত্যার মধ্যে কোনটা কারণ, কোনটা ফল তা ভুললে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তান যে নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছিল, তাকে কিন্তু আমেরিকা-চীন-ইরান-জর্ডান-সৌদি বা বহু ইসলামি দেশ চোখ বন্ধ করে সমর্থন করেছিল। একমাত্র ভারত সেদিন আমাদের পাশে দাঁড়ায়।’

একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রেও ভারত আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে একাধিক বক্তা অভিমত প্রকাশ করেন।

সোয়াসে ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরামের এই সিম্পোসিয়ামের প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশে বাহান্ন বছর আগে যে একটি নারকীয় জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে সে বিষয়ে ব্রিটেন তথা ইউরোপের রাজনীতিক, নীতি-নির্ধারক, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে আরও সচেতনতা তৈরি করা এবং সেদিনের কথা যারা ভুলে গেছেন তাদের আবারও মনে করিয়ে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে এই সভা অনেকটাই সফল হয়েছে নিঃসন্দেহে।