ভারতের দক্ষিণের রাজ্য তেলেঙ্গানায় একসময় উচ্চবর্ণের শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে দলিত নারীদেরকে বাধ্য করা হত। উচ্চবর্ণের যেসব শিশুর মা মারা যেত বা যে শিশু ঠিকমতো মায়ের দুধ পেত না, এমন শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে হত দলিত নারীদের। আল জাজিরার এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন মতে, উচ্চবর্ণের শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে বাধ্য করার ঘটনা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে সম্প্রতি শিশুখাদ্য সহজলভ্য হওয়ায় তা অনেকটাই কমে এসেছে। যেসব নারীদের বুকের দুধ খাওয়াতে বাধ্য করা হত তাদের অনেকেই আজও জীবিত আছেন।
সত্তরোর্ধ নারী ইয়েল্লাম্মার কথায় ও তার নাতনি সমাজবিজ্ঞানী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক জাহ্ণবি উপ্পুলেতির লেখার মধ্যদিয়ে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের সমাজের একটি করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
৭৫ বছর বয়সী ওই নারীর নাম ইয়েল্লাম্মা। তিনি মূলত মাদিগা নামে একটি দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। যে সম্প্রদায়ের বাস প্রধানত ভারতের দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে। ভারতের বর্ণপ্রথা অনুসারে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘অস্পৃশ্য’ বিবেচনা করা হয়।
বর্ণপ্রথায় সবার ওপরে ব্রাহ্মণ তথা পুরোহিত শ্রেণি, এরপর ক্ষত্রিয় তথা যোদ্ধা ও শাসক, এরপর বৈশ্য তথা ব্যবসায়ী) ও শূদ্র তথা শ্রমিক শ্রেণি রয়েছে। দলিতরা ওই চার বর্ণের বাইরে পঞ্চম শ্রেণির বা নিচু জাতের হিসেবে বিবেচিত।
ভারতে বর্ণ নির্ধারিত হয় জন্মের মাধ্যমে। যা প্রায়ই শ্রেণি বিভাজনের মূলে থাকে। এক সময় দলিতদের শিক্ষার মতো নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। সম্প্রতি যদিও শিক্ষার মধ্যদিয়ে কিছু দলিত আধুনিক জীবনযাপন করার সুযোগ পেয়েছে।
তবে মাদিগাদের মতো অনেক সম্প্রদায় এখনও জুতা তৈরি ও মেরামত করা, চামড়া প্রস্তুত করা ও মৃত প্রাণী পরিষ্কার করার মতো কাজেই রয়ে গেছে। এখনও তারা জোরপূর্বক শ্রম, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের শিকার।
১৯৬০-এর দশকে মাদিগা সম্প্রদায়ের আরও অনেক নারীর মতো দৈনিক মজুরির বিনিময়ে কৃষিক্ষেতে কাজ করতেন ইয়েল্লাম্মা। এর বাইরে আরও একটি কাজ ছিল যেটা মাদিগা নারীরা করতে বাধ্য হতেন।
প্রতিবেদন মতে, দুধ খাওয়াতে বাধ্য হতেন এমন কাউকে চিনতেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে ইয়েল্লাম্মা জানান, তিনি এমন অনেককেই চেনেন।
গল্পে গল্পে তিনি বলেন, তিনি যখন কিশোরী, তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় ২০ বছরের তরুণী আক্কাম্মার (ছদ্মনাম)। তারা একই গ্রাম গুন্দ্রাথিমাদুগুতে থাকতেন। আক্কাম্মাকে ‘উচ্চবর্ণের’ শিশুদের নিজের বুকের দুধ খাওয়াতে ও দেখভাল করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
ইয়েল্লামার মতে, সেটা ১৯৬০-এর দশকের কথা। সে সময় আক্কাম্মা প্রথম একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর সঙ্গেই থাকতেন তিনি। তার বাড়ির সামনেই ইয়েল্লাম্মার বাড়ি ছিল। ইয়েল্লাম্মার মা আক্কাম্মার শাশুড়ির সঙ্গে একই মাঠে কাজ করতেন।
সন্তান জন্মের প্রায় পাঁচ মাস পর ওই এলাকার এক ভূস্বামী আক্কাম্মাকে ডেকে পাঠান। সে সময় তেলেগু ভাষায় ভূস্বামীকে ‘ডোরা’ বলা হতো। তেলেঙ্গানা অঞ্চলে ভূস্বামী বা জমিদাররা শূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিল।
ঐতিহ্যগতভাবে এই সামন্ত জমিদাররা অনেক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রতিটি গ্রামে একাধিক ডোরা পরিবার থাকত। এই ভূস্বামীরা বিশাল বাড়ি ও অনেক জমির মালিক ছিলেন। এসব জমিতে নিম্নবর্ণের মানুষ কাজ করতেন।
ভূস্বামীর ২০ বছর বয়সী স্ত্রীও কয়েক সপ্তাহ আগে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সন্তান ঠিকমতো মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছিল না। এ কারণে সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য আক্কাম্মাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইয়েল্লাম্মা বলেন, আক্কাম্মা নিজের সন্তানকে দিনে অন্তত সাত থেকে আট ঘণ্টার জন্য বাড়িতে রেখে যেতেন। বাড়ি ফেরার পরও মাঝেমধ্যে তাকে ডোরা তথা ভূস্বামীর বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো। এভাবে ডোরার সন্তানকে বেশি দুধ খাওয়ানোর কারণে তার নিজের সন্তান পর্যাপ্ত দুধ পেত না, ক্ষুধার্ত থাকত।
প্রতিবেদন মতে, ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচলিত পিতৃতন্ত্র, বর্ণপ্রথা ও কর্তৃত্বের কাঠামো দলিত নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জমিদারের সন্তানকে নিজের বুকের দুধ খাওয়ানো ও গৃহশ্রম দিতে দলিত নারীদের বাধ্য করানো হত। এ ছাড়া উচ্চবর্ণের পুরুষেরা দলিত নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নও চালাতেন।
ইয়েল্লাম্মা বলেন, ‘তারা আমাদের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ভাবতেন। আমাদের শরীরে যা কিছু আছে, এমনকি নিজের সন্তানের জন্য রাখা বুকের দুধও তারা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন।’ তিনি আরও বলেন, নারীরা এতে বাধা দিতে পারতেন না। বাধা দিলেই তাদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।
ভূস্বামীরা দলিত নারীদের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে ভাবতেন। ইয়েল্লাম্মার কথায়, আমাদের শরীরে যা কিছু আছে, এমনকি নিজের সন্তানের জন্য রাখা বুকের দুধও তারা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতেন। নারীরা এতে বাধা দিতে পারতেন না। বাধা দিলেই তাঁদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন চালানো হতো।