যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (আইপিএস)’ যাচাই-বাছাই করছে সরকার। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলেন লবাখ গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরের সময় ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর সফরে আবারও বার্তা এসেছে, বাংলাদেশকে তাঁর ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জাপান সফরের সময় ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক কাঠামো (আইপিইএফ) সৃষ্টির ঘোষণা দেন। সেই ফোরামেও বাংলাদেশকে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ইন্দো-প্যাসিফিক ভাবনা ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। এতে নিরাপত্তা, সামরিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয় আছে। বাংলাদেশ বরাবরই সামরিক কোনো বলয়ে যোগ দেওয়ার বিপক্ষে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগ, এমনকি ইন্দো-প্যাসিফিকের আওতায় অর্থনৈতিক উদ্যোগ নিয়েও চীনের জোরালো সন্দেহ ও আপত্তি আছে। চীন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মূল লক্ষ্য চীনকে ঠেকানো।
মার্কিন রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলেন লবাখ বাংলাদেশ ছাড়ার রাতেই সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং। বেইজিং থেকে আফ্রিকা যাওয়ার পথে ফ্লাইটে জ্বালানি সংগ্রহের ওই যাত্রাবিরতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক ও বক্তব্যের দিকে নিবিড় দৃষ্টি রাখছেন কূটনীতিকরা। ছিন গ্যাং এ বছরের শুরুতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর এটিই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর এবং অন্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। ঢাকার ওই বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশ সবার সঙ্গে চলছে। বাংলাদেশ ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাস করে। সময় সময় চীনকেও বাংলাদেশ সমর্থন দেবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন আরো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—দুই দেশকে একসঙ্গে সন্তুষ্ট রাখা খুব চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ সেই কাজটি করে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড ডু আজ শনিবার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। এ সফরেও ইন্দো-প্যাসিফিকসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি তাঁদের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। বাংলাদেশ তুলে ধরবে তার নিজস্ব অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগ নিয়ে গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মূলত ইন্দো-প্যাসিফিকের অর্থনৈতিক কাঠামো বা ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক ফোরাম নিয়ে। মন্ত্রী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু দেশ। তারা যদি গঠনমূলক কোনো পরামর্শ দেয়, তা হলে আমরা তা গ্রহণ করি। আমরা এরই মধ্যে তার নমুনাও দেখিয়েছি অনেক। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের প্রতি খুব খুশি থাকা উচিত।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘আমরা এ দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করতে প্রস্তুত। সেটি যদি হয় ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরামে যোগদান করলে আমাদের লাভ হবে, তাহলে আমরা সেটা করব। আমরা এগুলো এখনো যাচাই-বাছাই করছি। আমাদের মঙ্গল যাতে হয় সেগুলোতেই আমরা যোগদান করব।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। সেই সঙ্গে আমরা চাই, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে। আমরা এগুলো ‘স্টাডি’ করছি। তখন আমরা জানাব।’
মন্ত্রী বলেন, ‘তবে আমাদের নীতিগতভাবে খুব আপত্তি নেই। আমরা যে ইস্যুগুলো দেখলাম, এগুলো এতে অস্পষ্ট। এতে যোগ দিলে কী লাভ হবে, সেগুলো খুব উল্লেখ নাই। সে কারণে আমরা এখনো বোঝার চেষ্টা করছি।’
ডোনাল্ড লুর বাংলাদেশ সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বলেছে, ‘ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। শ্রম ও মানবাধিকারের প্রেক্ষাপটে তাদের ভাবনা শোনা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরো জোরদারে আলোচনা ওই বৈঠকগুলোর উদ্দেশ্য।’
ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর চলতি মাসে বাংলাদেশে মার্কিন প্রতিনিধিদলের দ্বিতীয় সফর। চার দিনের সফর শেষে গত মঙ্গলবার ঢাকা ছেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক এইলেন লবাখ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক এই শোলেটের সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফর নিয়েও আলোচনা চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র তার বৈঠক ও আলোচনাগুলোতে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো ইস্যু তুলে ধরছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকা খুব স্বাভাবিক। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যা বিশ্বাস করে বাংলাদেশও তা বিশ্বাস করে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এগুলোতে বাংলাদেশ শুধু বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশ পৃথিবীতে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ৩০ লাখ লোক রক্ত দিয়েছে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার, মানবিক অধিকারকে সমুন্নত রাখার, ন্যায়ের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রও এগুলো চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের নীতি ও মূল্যবোধ মোটামুটি এক।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দুনিয়াতে নির্বাচনের এক মাস দুই মাস আগে কথাবার্তা হয়। আমাদের দেশ এক তাজ্জবের দেশ। তার মানে হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকে খুব পছন্দ করেন। এ কারণে এক বছর আগেই খুব তোড়জোড় শুরু করেছেন। নির্বাচন হবে আমাদের শাসনতান্ত্রিক নিয়মে।’
মন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার নিয়ে আমাদের সুপারিশ করার দরকার নেই। কারণ এগুলো আমাদের মজ্জাগত। আমাদের অন্তরে আছে। আমাদের লোকজনই ঠিক করবে কোথায় কিভাবে হবে।
মন্ত্রী আরো বলেন, ‘অন্যরা যদি কিছু সুপারিশ করে তা শুনব। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের জনগণের যদি মঙ্গল হয়, তবে তা গ্রহণ করব।’