অসীম কুমার উকিল
দেশের উল্লেখযোগ্য যে কোনো পরিবর্তনে এ দেশের ছাত্রসমাজের ভূমিকা প্রশংসনীয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই তো এ দেশের গৌরব আর অহঙ্কারের সবকিছুতেই ছাত্র রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। যে জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে বলেছিলেন- ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস।’
বস্তুত ছাত্র রাজনীতি হলো নেতা তৈরির কারখানা। গত ৫১ বছরের ইতিহাসে রাজনীতিতে যাঁরাই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ছাত্র রাজনীতি থেকে দীক্ষা-শিক্ষা-অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হয়ে ওঠা। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এ অভিজ্ঞতা সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেশ পরিচালনায় সাহায্য করছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ও ভিপি ছিলেন।
এই যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, এর নেতৃত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাঙালি জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই সংগঠনের জন্ম। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির মৌলিক অধিকার আদায়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা। এই ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন এ বছর ‘প্লাটিনাম জয়ন্তী’ বা ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। একটি ছাত্র সংগঠনের জন্য এটা কম দীর্ঘ পথ নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গঠিত নতুন কমিটি তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করবে বলে সবার মতো আমিও প্রত্যাশা করছি। একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে আমাদের সময়ের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।
আমি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক এবং পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। পরবর্তী সময়ে আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করি। পরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক; সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। ছাত্রলীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, তা পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে নিশ্চিতভাবেই সহায়ক হয়েছে।
আমাদের ছাত্র রাজনীতির সময়ে ক্যাম্পাসগুলো অস্ত্রধারীদের অভয়ারণ্য ছিল। সামরিক সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পাসগুলোতে অবৈধ অস্ত্রের মজুত গড়ে উঠেছিল। কথায় কথায় গুলি, বোমা ফুটত। কোনো কোনো ক্যাম্পাসে রগকাটা রাজনীতির রাজত্ব ছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ক্যাম্পাস হতো রক্তাক্ত। প্রায়ই অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেত। সেশনজট তখন একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
মনে পড়ে, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র রাজনীতিতে বয়সের কোঠা নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দেন। সেই মতো ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে (১৯৯২-৯৩) ছাত্রনেতাদের বয়সসীমা ২৭ বছর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে সময় বয়সের এ বেড়াজালের কারণে অনেককেই বিদায় নিতে হয় ছাত্র রাজনীতি থেকে। অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সী মঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী হন ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ইকবালুর রহিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই থেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে বয়স মেনে চলা শুরু হয়। একই সঙ্গে অবিবাহিতদেরও নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত দিয়ে দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপ এ দেশের ছাত্র রাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আজকে এটি প্রমাণিত সত্য- নিয়মিত ছাত্রদের হাতে ছাত্র রাজনীতি নিরাপদ। ফলে ক্যাম্পাস আজ সন্ত্রাসমুক্ত; সেশনজট সুদূর পরাহত। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বকেও এ দিকটি বিবেচনায় রেখে চলতে হবে সব পর্যায়ে।
ছাত্রলীগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নেতৃত্বের মধ্যে মেধার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা গড়ে তোলা। সে জন্য নিয়মিত সম্মেলন অনুষ্ঠানের দিকে নজর দিতে হবে। আমার সময়ে সব ক’টি জেলা সম্মেলন সমাপ্ত করেছিলাম এবং জেলায় বসেই সে জেলার কমিটি ঘোষণা করেছিলাম। এটি একটি কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় ছাত্রনেতাদের নির্মোহ থেকে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক সংগঠন অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের সহায়তা নিতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় ছাত্রনেতাদের পরামর্শ দিতে হবে; সহযোগিতা করতে হবে।
ছাত্র রাজনীতি ঘিরে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। ফলে কাজও অনেক। কিন্তু সময়ের বিবেচনায় আমার কাছে মনে হয়, সংগঠন গোছানোই এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজটি করতে পারলেই ছাত্র রাজনীতি প্রাণ ফিরে পাবে; দেশবাসী আশাবাদী হবে।
অসীম কুমার উকিল এমপি: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ