ওমান দেশ আরবের প্রাচীনতম স্বাধীন রাস্ট্র

274
ওমান

ওমান আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোনাতে অবস্থিত রাষ্ট্র। এটি একটি মরুভুমির দেশ, যেখানে সুউচ্চ পর্বতমালার ঠিক পাশেই রয়েছে উজ্জ্বল শুভ্র বালুর সমুদ্র সৈকত। এখানে সংখ্যালঘু ইবাদি মুসলিম লোকেরা বাস করে। এরা শিয়া ও সুন্নীদের চেয়ে স্বতন্ত্র। বহু শতাব্দী ধরে ওমান ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের একটি অন্যতম কেন্দ্র ছিল। ১৭শ থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত এটি একটি ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল। ওমানের রাজা সুলতান উপাধি ব্যবহার করেন এবং দেশটির সরকারি নাম ওমান সালতানাত।ওমানের রাজধানী মাস্কাট, সরকারি ভাষা আরবি,রাষ্ট্রধর্ম ইবাদি ইসলাম, জাতীয়তা-ওমানি,সরকার পূর্ণ রাজতন্ত্র। ওমানের অতীত সুলতান হাউস অফ আল বুসাইদের প্রতিষ্ঠাতা এবং পনেরো প্রজন্মের বংশধর আরব বিশ্বের দীর্ঘতম শাসনকর্তা সুলতান কাবুস বিন সাইদ ৭৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব বিশ্বে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী নেতা ছিলেন। বর্তমানে ওমান দেশটি কাবুস বিন সাইদ আল সাইদের মৃত্যুর পর হাইথাম বিন তারিক আল সাইদকে দেশের নতুন শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। তখন হাইথাম বিন তারিক দেশের নতুন সুলতান হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন।

দেশটির মোট আয়তন ৩,০৯,৫০০ কি.মি.,মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৪২,৯৮,৩২০ জন। মুদ্রার নাম -রিয়াল।
ওমানের বাটিনা অঞ্চলে নাখাল খেজুর গাছের খামার

ওমানের পশ্চিমে ইয়েমেন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, পূর্বে আরব সাগর, উত্তরে ওমান উপসাগর। ওমানের সবচেয়ে উত্তরের অংশ মুসান্দাম উপদ্বীপ হর্মুজ প্রণালীর দক্ষিণ তীর গঠন করেছে। পারস্য উপসাগরে ওমানের কয়েক কিলোমিটার তটরেখা আছে। মাস্কাট ওমানের রাজধানী এবং বৃহত্তম নগর।

খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগেকার একটি সুমারীয় উৎকীর্ণ লিপিতে ওমানকে “ নাজান ’ বা ‘ নাগান ’ ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে । ওমানের সমুদ্রবন্দরসমূহের সঙ্গে সেকালে সুমারীয় নগরী ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। লোবানের জন্য তখন বিখ্যাত ছিল ওমানের দোফার অঞ্চল । ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তীন, মিসর এবং ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ইউরোপীয় দেশসমূহে লােবান রফতানী হত এখান থেকে । গ্রীক ও রােমানদের কাছেও সুপরিচিত ছিল প্রাচীন ওমান । রােমান ভৌগােলিক বিবরণে ‘ ওমানা ‘ নগরীরর উল্লেখ রয়েছে । রােমান নাবিকদের কাছে মস্কট বন্দর ‘ পাের্টাস মস্কাস নামে পরিচিত ছিল । রােমান ভূগােলবেত্তা ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী প্লিনি দি এল্ডার ওমানের মাসিরা দ্বীপের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, এই দ্বীপটিতে অসংখ্য কচ্ছপ দেখতে পাওয়া যায় । | আলেকজান্ডারের নৌ – সেনাপতি নিয়ারকাস – এর বর্ণনায় রয়েছে এই উপসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কে অনেক বিশদ এবং চিত্তাকর্ষক তথ্য খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে নিয়ারকাস সিন্ধুনদের মােহনা থেকে তার নৌবহর নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন পারস্য – উপসাগর । তার পথে পড়ে বেলুচিস্তানের লাসবেলার সােমিয়ানি উপসাগর । তার বিবরণে সােনমিয়ানি উপসাগরকে ‘ ওরিইতাই উপসাগর ‘ বলে উল্লেখ করা হয় । মাকরান উপকূল ধরে তিনি হরমুজ প্রণালীর পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন । প্রণালীর পশ্চিম পাশ ঘেঁষেই ওমানের উপকূল । নিয়ারকাস কারমানিয়া তথা বর্তমান লারিস্তান উপকূল ধরে খুজিস্তান হয়ে বার কাছে তাইগ্রিস বা দজলা নদীর মােহনায় পৌঁছান । তিনি মাকরানকে ইকথিওফাসি ’ ফার্স ‘ বা ইরানকে ‘ পারসিস ’ খুজিস্তানকে ‘ সুইসিস ‘ এবং তাইগ্রিস নদী বা দজলাকে ‘ পাসিটিগরেস ‘ বলে উল্লেখ করেন । পরবর্তী যুগের গ্রীক ভূগােলবেত্তা ‘ইরাসেস্থিনিস্’ আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহের বর্ণনা দিয়েছেন । | খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের একজন লেখক ওমানের দোফার উপকূলভূমিকে লোবানের দেশ বলে অভিহিত করেছেন । তিনি মুসানদাম উপদ্বীপের পর্বতমালা, জাবাল আখদার, হরমুজ প্রণালী এবং প্রণালীর উত্তরের কুহ – ই – মুবারক বাস আল কুহ এর কথা বলেছেন । তাঁর বর্ণনায় আছে — উপসাগরের পূর্বতীরে পারসিতাই বা পার্থিয়ানদের ( পারসিক ) দেশ ।

১৯৭০ সালে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে ওমানের সুপ্রাচীন অতীতের অনেক মুল্যবান নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ওমানের ‘ফালাই’ সেচব্যবস্থা দক্ষিণ আরবের প্রাচীন হিমারীয়দের সময় থেকে প্রচলিত। সুলায়মান এ-ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন বলে ওমানের কৃষকদের ধারণা । খ্রিস্টপূর্ব যুগে দক্ষিণ আরবের কাহতান ও উত্তর আরবের নিষার গোত্রের লোকেরা ওমান উপকূলে এসে বসবাস শুরু করেন । খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের দিকে ইয়ামেনের ঐতিহাসিক মারিব বাধ বন্যায় বিধ্বস্ত হলে সে অঞ্চল থেকে ‘মালিক বিন ফাহদের’ নেতৃত্বে ওমানে এসে বসবাস শুরু করে আয্দ গোত্রের লোকেরা । নাসর বিন – আয্দ ছিলেন এই গোত্রের প্রধান । এরাই ওমানীদের পূর্বপুরুষ । | ইসলামের প্রথম যুগে আমর বিন আস – এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ওমানে প্রবেশ করে এবং তখন থেকেই এখানে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রচলন হয় । উমাইয়া শাসনামলে ওমানের জনসাধারণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে । পরবর্তীকালে তারা গ্রহণ করে ইবাদী মতবাদ । এই মতবাদের মূল কথা হল — খিলাফত বংশানুক্রমিক কিংবা উত্তরাধিকারভিত্তিক হতে পারে না । খ্রিস্টীয় আঠারো শতকে এই মতবাদের ভিত্তিতে ওমানীরা নিজস্ব ইবাদী ইমামত প্রতিষ্ঠা করে । বর্তমান শাসকবংশ এই ইমাম পরিবারেরই অন্তর্গত । খ্রিস্টীয় অষ্টম শতক থেকে গোটা মধ্যযুগ পর্যন্ত ওমানে নৌবাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে । মুহাম্মদ বিন কাসিম আল – সাকাফী ওমান হয়ে মাকরান উপকূলের মধ্য দিয়ে সিন্ধুর মোহনায় উপনীত হন এবং সেখানে প্রথম ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । সিন্ধুর উপকূলভূমিই ছিল দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের আদি কেন্দ্র । সে যুগেই ওমানের সাথে ভারতের দক্ষিণ – পশ্চিমের মালাবার উপকূলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় । আরবদের কাছে কুলাম – মালে ’ নামে পরিচিত ছিলো মালাবার উপকূল ।

৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম বণিকরা ওমান উপকূল হয়ে সমুদ্র পথে চীনের ক্যান্টন বন্দরে গমন করেন । ক্যান্টন তখন খানকু নামে পরিচিত ছিল । চীনে ছিল তখন তাং – বংশের শাসন । হুদুদুল আলম ’ নামক ভূগোল ও ইতিহাস বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থে সেকালের একটি চীন – আরব ও মালয়ী বংশোদ্ভূত তাসিহ ও পো – সে বণিকদের তাং – শাসন বিরোধী সেকালের একটি অভ্যুত্থানের উল্লেখ রয়েছে । পর্যটক ও ভূগোলবিদ ইসতাখারি মাসুদী,আবু যুলাফ আল – খারাজি, ইবনে হাওকিল এবং মুকাদ্দিসী । তাদের বিবরণে ওমান ও সিন্ধুসহ এই উপকূল অঞ্চলের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন । ৮৫১ সালে লিখিত ‘ আখবার আলমিন ওয়াল হিন্দ ’ গ্রন্থে আরব সাগর, পারস্য উপসাগর এবং ভারতীয় উপকূলে আরব নাবিকদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনী সন্নিবেশিত । আরবদের কাছে ভারত মহাসাগর ‘ বাহরুল আকবর ’ আটলান্টিক মহাসাগর ‘ বাহরুল মুহিত এবং পারস্য উপসাগর ‘ খালিজ ’ বা ‘ লিসান ’ ( আরব সাগরের জিহ্বা ) নামে পরিচিত । উমাইয়া, আব্বাসী, ইরানী, মোঙ্গল ও ইউরোপীয় আধিপত্যের যুগেও ওমান মোটামুটি তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে সক্ষম হয় ।

মোস্তাফিজুর রহমান
বি এ(অনার্স),এম এ(ফার্স্ট ক্লাস) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এম ফিল গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।