রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর তাদের কর্মীদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেছে পাঁচ বছর আগে। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, চিকিৎসকসহ হাসপাতালের অন্যান্য কর্মী নিয়োগের এখতিয়ার নেই ফায়ার সার্ভিসের। তাই সরাসরি চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিতে পারেনি তারা। এতে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা শুরু করা যায়নি।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদের সচিব কবির বিন আনোয়ারের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এই হাসপাতালের জন্য চিকিৎসকসহ ৫৫টি পদের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। প্রস্তাবটি এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন পেলে প্রজ্ঞাপন জারি ও নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে এটি আর এখন শুধু ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জন্য বার্ন হাসপাতাল হিসেবে থাকছে না; জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে সাধারণ মানুষও চিকিৎসা নিতে পারবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ করা হয়েছে ২৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। পাঁচ বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে থাকায় অকেজো হয়ে গেছে হাসপাতালের জন্য কেনা কোটি টাকার যন্ত্র। হাসপাতালের জন্য কেনা গাড়ি ব্যবহার করছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অগ্নিদগ্ধের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রকল্পটি ২০১২ সালে অনুমোদিত হয়। পাঁচতলা হাসপাতাল ভবনের কাজ শেষ করে ২০১৭ সালের জুনে ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। একই সময় হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম, বার্ন উপকরণ, সার্জিক্যাল উপকরণ, ফার্নিচার কেনাকাটাও শেষ করা হয়। এখন চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ না হওয়ায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম শুরু করা হয়নি। তবে চিকিৎসক ও নার্সের পদ সৃষ্টির জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে ঘুরছেন ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে চিকিৎসকসহ ১৫২টি পদ সৃষ্টির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে ৭৮টি পদ সংরক্ষণে সম্মতি দিয়ে স্বরাষ্ট্রের সুরক্ষা বিভাগে পাঠায়। সুরক্ষা বিভাগ এসব পদ সৃষ্টির সম্মতির জন্য অর্থ বিভাগে অনুরোধ জানায়। কিন্তু অর্থ বিভাগ এতে সম্মতি দেয়নি। এরপর বিষয়টি ঘুরেফিরে আবার অর্থ বিভাগে আসে। অর্থ বিভাগ এবার শর্ত জুড়ে দেয়, এটিকে জেনারেল হাসপাতাল করতে হবে এবং ২৫ শতাংশ সেবা সাধারণ মানুষকে দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর অর্থ বিভাগের শর্ত মেনে ফের সচিব কমিটিতে পদ সৃষ্টির প্রস্তাব পাঠায়।
ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সচিব কমিটিতে উল্লিখিত ৫৫টি পদ প্রস্তাব আকারে অনুমোদন পেলেও চিকিৎসকসহ অন্যান্য পদে নিয়োগ দিতে তিন-চার বছর সময় লাগবে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ও প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ ও সুরক্ষা বিভাগের নিয়ন্ত্রণে।
ফায়ার সার্ভিস জেনারেল হাসপাতাল : অর্থ বিভাগ হাসপাতালটিকে ‘স্পেশালাইজড বার্ন ট্রিটমেন্ট হাসপাতালের’ বদলে জেনারেল হাসপাতাল করা শর্ত দিয়েছে। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে বলেছে। অর্থ বিভাগের শর্ত মেনে হাসপাতালটিকে ‘৫০ শয্যাবিশিষ্ট ফায়ার সার্ভিস জেনারেল হাসপাতাল’ নামে প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাব অনুযায়ী, সচিব কমিটি হাসপাতালটিকে জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এতে যে উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল, পুরোপুরি এর বাস্তবায়ন হবে না। তবে ফায়ার সার্ভিসের নন-টেকনিক্যাল কর্মকর্তারা হাসপাতালটি পরিচালনা করবেন। জেনারেল হাসপাতালের প্রধান হবেন একজন সুপারিনটেনডেন্ট। এ ছাড়া সিনিয়র কনসালট্যান্ট, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও মেডিক্যাল অফিসার পদের কর্মকর্তারা নিয়োগ পাবেন।
ফায়ার সার্ভিস ও ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন বলেন, ‘চিকিৎসকের অভাবে দীর্ঘদিন সেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি। গত ছয় মাস আগে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুজন চিকিৎসক দিয়ে প্রাথমিক সেবা শুরু করেছি। এখন নতুন জনবলের পদ সৃষ্টির প্রজ্ঞাপন হলে চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ দেওয়া যাবে। তবে কোন বিভাগে কতটি পদ হচ্ছে, সেটা এখনো জানি না। ’ তিনি বলেন, বার্নের বদলে জেলা সদর হাসপাতালের মতো জেনারেল হাসপাতাল করা হবে। হাসপাতালটির সেবা কার্যক্রম দ্রুত চালু করতে বিভিন্ন চিকিৎসক প্রয়োজন।
কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট : সুরক্ষা সেবা বিভাগ সূত্র ও সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, দীর্ঘ পাঁচ বছর আগে কেনা কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে গেছে। আবার বার্ন হাসপাতাল জন্য কেনা সচল যন্ত্রপাতিও কাজে আসবে না। এই প্রকল্পের আওতায় ৩৩০ ধরনের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কেনা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধশত যন্ত্রপাতি ও উপকরণের মেয়াদ এর মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বাকি যেসব যন্ত্রপাতি ও উপকরণ রয়েছে, সেগুলোও ব্যবহার না হওয়ায় ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কম্পিউটার, প্রিন্টার ও ফটোকপির মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। জেনারেল হাসপাতাল পরিচালনার জন্য এখন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম নতুন করে কিনতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিং কমপ্লেক্সে হাসপাতাল নির্মাণ করায় স্থান সংকুলান হবে না।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন বলেন, বার্ন চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি প্রয়োজনে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালে দেওয়া হবে। জেনারেল হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলতে পারবে। ’
জেনারেল হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব সামসুল আরেফিন বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস হাসপাতালের চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে বৈঠকের এজেন্ডা ছিল। তবে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলব না। ’
গাড়ি ব্যবহার করছে অধিদপ্তর : প্রকল্পের আওতায় একটি জিপ গাড়ি কেনা হয়। হাসপাতাল চালু হলে গাড়িটি চিফ কনসালট্যান্টের ব্যবহার করার কথা ছিল। চিকিৎসক নিয়োগ না হওয়ায় গাড়িটি ব্যবহার করছে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর। এখন জেনারেল হাসপাতাল হওয়ায় চিফ কনসালট্যান্টের পদও অনুমোদন পাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া অগ্নিপ্রতিরোধক যন্ত্রপাতি কেনা হলেও সেগুলো স্থাপন করা হয়নি। মজুদ থাকা অবস্থায় সেগুলোর কেমিক্যালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, অপরিকল্পিতভাবে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়েছিল। কারণ বার্ন ইউনিট থাকার পরও এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। চিকিৎসক ও নার্সের নিশ্চয়তা না পেয়েই কিভাবে একটা হাসপাতাল হয়ে গেল? সরকারের এত টাকা অপচয় করা—এটা একটা দুর্নীতি। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, জেনারেল হাসপাতাল করা হলে কিছু মানুষের উপকার হবে।