মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে কয়েকটি বিদেশি দূতাবাস যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে, সেটিতে কূটনীতিকদের নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক আইন ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন থেকে মুক্ত থাকার জন্য যথেষ্ট সতর্কতা লক্ষ্য করা গেলেও তাদের বিবৃতিটি ভিয়েনা কনভেনশনের লংঘন থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। বিবৃতিতে নির্বাচনকে সার্বজনীন মানবাধিকারের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, যেহেতু কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কূটনীতিকরা হস্তক্ষেপ করতে পারেন না, তাই নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়েও বিদেশি কূটনীতিকরা এমন কোনো মন্তব্য করতে পারেন না যেটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।
বিজ্ঞাপন
ওই বিবৃতিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৮ সালে প্রণীত জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা বলা হয়। ওই কূটনীতিকদের নিশ্চয়ই মনে আছে বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সর্বজনীন মানবাধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী অবৈধ সরকারগুলো সংবিধানের সুরক্ষিত এই মানবাধিকারগুলো বারে বারে ভুলুণ্ঠিত করেছে। বেয়নেটের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। কূটনীতিকরা কী ভুলে গেছেন সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা থেকে উৎসারিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি আন্তর্জাতিক চুক্তি (covenants) অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ‘International covenant on economic social and cultural rights’ এবং ‘International covenants on civil and political rights’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যথাক্রমে ১৯৯৮ এবং ২০০০ সালে অনুসমর্থন করার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এই চুক্তি দুটিতে পক্ষভুক্ত হয়েছিল। খালেদা জিয়ার ১০ বছরের শাসনামলে মানবাধিকারের কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করেনি। অসাংবিধানিক সরকারগুলোর সময়ও এরকম চিত্র ছিল। জাতির পিতার সরকার ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রায় সকল চুক্তিই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকারের সময় অনুসমর্থন করা হয়েছে।
কূটনীতিকদের বিবৃতিতে বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য করা হয়। তারা কী জানেন যে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে নির্বাচন ব্যবস্থা সেটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের। বাংলাদেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠাসহ নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ রাখার জন্য সকল সংস্কারের কাজ আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে।
নির্বাচন নিয়ে সংস্কার কেন করতে হলো? ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া ও গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে মার্শাল ল’ দিয়ে মিলিটারি ডিক্টেটর জিয়া একই সাথে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতা দখল, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনকে রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে কাজে লাগানো, ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, দল গঠন, সংসদ নির্বাচন সবই ছিল জনগণের সাথে প্রতারণা। আরেক সামরিক শাসক এরশাদ জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমতা দখল, দল গঠন ও নির্বাচনী প্রহসন করেন। গণআন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হযন। ১৯৯৩ সালের ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়লাভ করলে খালেদা জিয়া সন্ত্রাস বাহিনী দিয়ে ছয়জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে হত্যা করেন। মাগুরা উপনির্বাচনসহ উপনির্বাচনগুলোতে ব্যাপকভাবে ভোট কারচুপি করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া গণকারফিউয়ের মধ্যে একদলীয় নির্বাচন করে ব্যাপকভাবে ভোট কারচুপি করে। নগ্নভাবে ভোট কারচুপির কারণে এক মাসের মাথায় ব্যাপক গণআন্দোলনে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
২০০১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ ব্যাপক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। বিএনপির দুর্নীতি সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ সৃষ্টির ফলে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। বিএনপি ২০০৬ সালে নির্বাচনের ভোটার তালিকায় এক কোটি ২৩ লক্ষ ভুয়া ভোটারতালিকা যুক্ত করে। একপর্যায়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচন পদ্ধতিতে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব জনগণের কাছে তুলে ধরে। ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একে একে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করে।
শেখ হাসিনার সরকার বেশ কিছু আইন, বিধি-বিধান, নীতিমালা ও গাইডলাইন প্রণয়ন করে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান সংশোধন করে বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করে। ২০০৯ সালে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে সকল প্রশাসনিক, আইনি, রেগুলেটরি, লেজিসলেটিভ এবং আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। অথচ ২০০৯ সালের পূর্বে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ একটি দপ্তর ছিল। শেখ হাসিনার উদ্যোগের কারণে নির্বাচন কমিশন এখন সম্পর্ণরূপে স্বাধীন। এটি কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের মুখাপেক্ষি নয়।
কূটনীতিকরা কী এটি জানেন যে, পৃথিবীর কোনো দেশেই সরকারপ্রধান নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে তার নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতা কোনো নিরপেক্ষ সার্চ কমিটির কাছে হস্তান্তর করেনি। বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন করে এই কাজটি শেখ হাসিনাই করেছেন। বর্তমানে পৃথিবীর কোনো দেশেই এর চেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া নেই। এতদসত্তেও কিছু কূটনীতিক কেন এদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে কেন বিবৃতি প্রদান করেছেন সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। এটি আন্তর্জাতিক আইন ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। এই ধরনের কাজ শুধু বাংলাদেশের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। কারণ এই ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের লংঘনকে প্রশ্রয় দিলে এটি যেকোনো দেশেই ঘটতে পারে। যে সকল কূটনীতিক বাংলাদেশে এই বেআইনি কাজটি করছেন, তাদের দেশেও অন্য দেশের কূটনীতিকরা এই কাজটি করতে উৎসাহিত হবেন।
ভিয়েনা কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী কূটনীতিকরা যে দেশে কাজ করবেন সে দেশের সংবিধান এবং আইনের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখে কাজ করবেন। সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ওই কনভেনশনে আরো বিধান আছে যে, কূটনীতিকদের সকল কর্মকাণ্ড সেই দেশের (গ্রহণকারী রাষ্ট্র) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা ওই দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই প্রক্রিয়ার বাইরে কূটনীতিকদের অন্য কোনভাবে সে দেশের রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য, সকল দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং কিছু রাষ্ট্র প্রতিবছর মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। এই সকল রিপোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো প্রকাশ করা হয় এবং এ বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। এর বাইরে কূটনীতিকরা অন্য রাষ্ট্রে অবস্থান করে সেই রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ এমন কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবে না যেটি আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।
লেখক: তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ