আহমেদ জামাল
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনসহ চার দফা দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা অন্তত ৭টি রাজনৈতিক দল। আগামীকাল (সোমবার) পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে এসব দল যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
সূত্র মতে, শুরুতেই বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন, পথযাত্রা আলোচনা সভার মতো কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পরবর্তীতে সব দলের সমন্বয়ে বড় আকারের কর্মসূচি দেয়া হবে। এ ব্যাপারে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, সোমবার মগবাজার আল-ফালাহ্ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর তরফে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। একইভাবে একইদিন সমমনা দলগুলো যার যার অবস্থান থেকে অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা দেবে।
তিনি বলেন, এ সব দাবিতে ইতিপূর্বেও আমরা বিক্ষোভ সমাবেশ সেমিনার আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। কিন্তু কাজ না হওয়ায় নতুন কর্মসূচি দিতে হচ্ছে।
ইসলামী আনেদালনের সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করবেন শীর্ষ নেতারা। তিনি বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার সকল রাজনৈতিক দল আমাদের এই কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে। এরপরও সরকার দাবি পূরণে ব্যর্থ হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে।
জানা গেছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবিতে অনেকদিন থেকে সোচ্চার রয়েছে এইসব দল। তবে সম্প্রতি গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ঘটনার পর যোগ হয়েছে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণ। এ পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপে আশাব্যঞ্ছক ফল না পাওয়ার পর জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা দলগুলো কয়েক দফা বৈঠকে যুগপৎ কর্মসূচি শুরুর বিষয়ে একমত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই যুগপৎ আন্দোলনের নেতৃত্বে আছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ, মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন এবি পার্টি ও সরওয়ার কামাল আজিজীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি।
অন্যদিকে পিআর নিয়ে এখনো একমত না হলেও গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চায় এনসিপি। তবে দলটি এখনই সাত দলের কর্মসূচির সঙ্গে যুগপৎ কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। তারা আপাতত আলাদা কর্মসূচি নিয়ে ভাবছে।
এ ব্যাপারে এনসিপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, এনসিপি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চায়। বিভিন্ন দলের সঙ্গে এটিসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। অভিন্ন ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলনের আলোচনাও আছে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ওদিকে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবির বিষয়েও ৭ দলের নেতারা একমত হয়েছেন। তাদের বক্তব্য, ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলে ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোর কার্যক্রম কেন নিষিদ্ধ হবে না।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হয়েছে সম্প্রতি। তবে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি পিআর পদ্ধতির কঠোর বিরোধিতা করে আসলেও জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ সমমনা কয়েকটি দল এই পদ্ধতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। ফলে পিআর পদ্ধতির পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এদিকে পিআরের পক্ষে জনমত গঠনে বেশ তৎপর হয়ে উঠছে ইসলামী দলগুলো। গত ২৮শে জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করে ইসলামী আন্দোলন। সেখানে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে তুলে ধরেন বিভিন্ন দলের নেতারা। সেদিন ডান ঘরানার ১০টি রাজনৈতিক দল একমঞ্চে উঠে পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে দাবি তুলে ধরে বলেছেন, পিআর পদ্ধতি না হলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। মূলত ওইদিন থেকেই এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। যদিও ওইদিনই বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেছেন, একটি গোষ্ঠী নির্বাচনকে পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। তবে এই দাবির পক্ষের দলগুলো তাদের অবস্থানে বেশ অনড় আছে। জানা যায়, গত ১৩ই জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের ফলে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী নেপথ্যে থেকে ইসলামী দলগুলোকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা করে অবশেষে ২৮শে জুন ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে এক মঞ্চে ওঠেন তারা। ওই মঞ্চ থেকে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন কথা বলেন বক্তারা। তবে ওইদিনই এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়, তাদের উদ্দেশ্য আছে। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়।
পিআর নিয়ে এই দলগুলোর অবস্থানকে অনেকে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচন বিলম্বিত করারও কৌশল হতে পারে এটি। যদিও দলগুলোর নেতারা বলছেন, যৌক্তিক এবং জনগণের দাবি হিসেবে পিআর-এর পক্ষে তারা।
এ ব্যাপারে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ৫৩ বছর দেশে আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়েছে, আমরা এবার দলভিত্তিক নির্বাচন চাই। এতে প্রত্যেকটি ভোটের মূল্যায়ন হবে। তিনি বলেন, এত বছর ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন পদ্ধতি চলে আসছে। বর্তমান সরকার সংস্কারের মাধ্যমে জাতিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে ওয়াদাবদ্ধ। সরকারের সেই ওয়াদা পূরণ করতে হলে পিআর মানতে হবে। অন্যথায় দেশতো অনিশ্চয়তার দিকে যাবেই। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, রাষ্ট্রের সংস্কার নয়, শুধু নির্বাচন সংক্রান্ত যেসব সুপারিশ অতি জরুরি, অন্তত নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত, সেগুলোর সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচন শুধু একটি নির্বাচন নয়; এটি একটি বিপ্লব-পরবর্তী জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের সুযোগ। ফ্যাসিস্টদের বিচার এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের মধ্যদিয়েই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব।
– মানব জমিন