আব্দুল্লাহ আল আমিন ধুমকেতু
ভিনিউজ : পুঁজি-প্রযুক্তি আর পণ্যের দাপট বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক আইএমএফের খবরদারি পুব থেকে পশ্চিমে। হাতে হাতে আই ফোন, ম্যাকবুক। উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্ত-ও ভোগে মগ্ন। সাহিত্য তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়, আপাঙক্তেয়। প্রযুক্তি- আসক্ত নতুন প্রজন্ম রেস্তোরাঁ আর কফি শপে পান-ভোজনে ব্যস্ত। সাহিত্যের অগ্নি-উত্তাপ, আনন্দ-অমৃতের স্বাদ গ্রহণে সম্পূর্ণ উদাসীন তারা। জেড জেনারেশনের রসবোধ পরিতৃপ্ত করছে ফেসবুক আর টুইটারে। প্রাত্যহিক দিনযাপনের আমোদ-আহ্লাদে, প্রমোদ-বিনোদনে কিংবা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কোথাও সাহিত্য নেই। সাহিত্যের মতো রবীন্দ্রনাথও অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয়। এক, জাতীয় সংগীত পরিবেশনা ছাড়া, বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্রে কোথাও তিনি প্রয়োজনীয় নন। বাঙালির ব্যবহারিক-জীবনের কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক সভামঞ্চ থেকে আমাদের প্রধান রাজনীনিবিদরা তাঁর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে চান না। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে, পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে, সম্প্রীতি-উজ্জ্বল ও মানবিকতাবোধে দীপিত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁকে এতটুকুও যুক্তিসম্মতভাবে ব্যবহার করা হয় না। প্রশ্ন জাগে, তাঁর শিক্ষাচিন্তা বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে কতটুকু গ্রহণ করা হয়েছে? গ্রহণ করা হয়নি, মোটেই গ্রহণ করা হয়নি। সত্যি বলতে কী, তিনি এখন কোনো এক প্রয়াত পিতামহের প্রতিকৃতির দামি তৈলচিত্র ভিন্ন অন্যকিছু নয়। তিনি কেবলই এক শ্রেণির মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে শোভাবর্ধন করেন। শহুরে সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে তাদের ভাগ্যবদলের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন। স্বাধীনতার পর, রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা দর্শনের সঙ্গে আমাদের সামাজ-রাজনীতির যতটা ঘনিষ্ঠতা থাকার কথা ছিল, তার দশমাংশ-ও নেই। বরং আবদ্ধ হয়ে গেছেন উচ্চবর্গের উচ্চমঞ্চের ভক্তিময়তার ঘেরাটোপে। আমাদের সংস্কৃতির প্রধান আলোকস্তম্ভ হিসেবে তাঁকে উপস্থাপন করা যায়নি। তাঁর প্রতি আমজনতার ভালবাসা অবারিত হয়নি, জনসমাজের বিশাল অংশ তাকে সেইভাবে চেনে না, জানেও না। এখনও রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের কাছে ‘অধরা মাধুরী’, কারো কাছে ‘গুরুদেব, কবিগুরু’ বৈ অন্য কিছু নয়। কারো কাছে, ‘প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া কবি’, কারো কাছে, ‘উপনিষদের মায়াবাদে আচ্ছন্ন ভারতীয় কবি’। তবে বিশেষ বিশেষ পার্বণে-তিথিতে তাঁর গলায় গাঁদাফুলের মালা ঝুলিয়ে আমরা ধন্য হতে চাই। কেউ কেউ আবার ন্যাকামি করে বলে ওঠেন ‘ওগো তুমি আমার সর্বস্ব!’
তারপরও মাঝে মাঝেই তাঁর পানে চেয়ে বিস্মিত হই। উৎসব-পার্বণে শ্রদ্ধায় সম্ভ্রমে বিনয়ে তার প্রতিকৃতির সামনে নম্রনত শিরে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানাই, প্রণতি নিবেদন করি। তাঁর উত্তরাধিকারে গর্ব অনুভব করি। রঙ বেরঙের পাঞ্জাবি পরে গলাফাটিয়ে সুর করে বক্তৃতাবাজি করি। কিন্তু যাপিত জীবনের কোথাও তাঁকে কাজে লাগাতে পারি না। লাগাতে জানিও না! আমরা যারা সংস্কৃতিমান বাঙালি হিসেবে দাবি করি, তারা আবার বছরের প্রথম দিনের নতুন সূর্যকে অভিবাদন জানাই রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে। কিন্তু প্রতিদিনের কাজে কর্মে তাঁকে আমরা কতটুকু স্মরণ করি, কতটুকুই বা ব্যবহার করি? আমার কেবলই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথকে আমরা এখনো ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারিনি, বুঝতে পারিনি। তাঁর কাব্য প্রবন্ধ দর্শন ছোটগল্প চিত্রকর্ম যেমন বুঝিনি, তেমনই তাঁর গানও বুঝে উঠতে পারিনি। তাঁর গান এখনো আমাদের আত্মার সংগীত কিংবা ভালো লাগার ধন হয়ে উঠতে পারেনি। তাঁর গান শুনে আমুদগেঁড়ে স্থূলরুচির বাঙালির চিত্ত জাগ্রত হয় না। অতি-ভক্তি, বিগলিত শ্রদ্ধা আর সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁর আসল মূর্তিটি
জমাটবদ্ধ বরফের নিচে চাপা পড়ে গেছে। ন্যাকামি, আদিখ্যেতা, ধোপদুরস্ততা দিয়ে তথাকথিত গায়ক আর বুদ্ধিজীবীরা কেবল ঠুসিপরা-ভাববিলাসী রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন। তিনি কি ঠুসিপরা ছিলেন? তিনি কি দুঃখ-বেদনা, মঙ্গল-অমঙ্গল কিছুই দেখতে পেতেন না! ধোপদুরস্ত হয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেই কী রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা যায়? বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর অনেক চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাঁর সাহিত্যকর্ম, তাঁর শান্তিনিকেতন- শ্রীনিকেতন বাঙালি সমাজে উচ্চায়ত চিন্তার পারফেক্ট মানুষ সৃষ্টি করতে পারেনি। তারপরও তিনিই আমাদের বাতিঘর। আমাদের সমাজে উঁচুমাপের মানুষ তৈরির জন্য রবীন্দ্রনাথকে এখনো প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন। তবে আশ্রমিক রবীন্দ্রনাথকে নয়, প্রয়োজন ‘মাটি ও মানুষের কাছাকাছি’ পৌরুষদীপ্ত রবীন্দ্রনাথকে, যিনি সমস্যায় সংকটে আমাদের হয়ে লড়বেন। যিনি দৃঢ়তা নিয়ে বলবেন, ‘ ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।’ চাই সেই রবীন্দ্রনাথকে যিনি সমগ্র বাঙালিকে পূর্ণ ও পারফেক্ট মানুষ হিশেবে দেখতে চেয়েছিলেন, পাওয়ারফুল হিশেবে নয়। আজ ২৫ বৈশাখ । বিশ্ব কবির প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি
লেখক : শিক্ষক -গবেষক