১৬ বছর পর ১৫ লাখ কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিচ্ছে সরকার

প্রায় ১৬ বছর পর ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নিচ্ছে সরকার। চলতি বছর থেকেই প্রত্যেককে সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হবে। এবার ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ক্যাডারভুক্ত কর্মচারীরা প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে সম্পদবিবরণী দাখিল করবেন। নন-ক্যাডার কর্মচারীরা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদবিবরণী জমা দেবেন। আগামী বছর থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হবে। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯-এর বিধান বলে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সম্পদবিবরণী দাখিলের বিধান থাকলেও নতুন করে তা প্রতিবছর জমা দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। যেসব কর্মচারী সম্পদবিবরণী দাখিল করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে প্রথমে লঘুদণ্ড এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে গুরুদণ্ড আরোপ করা হবে।

রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে কর্মচারীদের সম্পদবিবরণী দাখিল সংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, আগে পাঁচ বছর অন্তর সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হতো। এখন থেকে প্রতিবছর দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হলো। সিলগালা খামে নিয়ম অনুসারে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে ওই কর্মচারীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ সম্পদবিবরণী জমা না দিলে তাকেও শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ বিধান সব কর্মচারীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে। তবে সম্পদবিবরণী অত্যন্ত গোপনীয় বিধায় তথ্য অধিকার আইনেও এ বিষয়ে কিছু চাওয়া যাবে না। তবে আদালতের আদেশ বা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে তা প্রকাশ করা যাবে। আমি আশাবাদী, দুর্নীতির লাগাম টানতে এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে।

বিদ্যমান নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দিতে হয়। এরপর পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম আছে। দুর্নীতি রোধ এবং চাকরিজীবীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আচরণ বিধিমালায় এমন নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা মানা হতো না। এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হবে। প্রতিবছর সম্পদবিবরণী দাখিলের বিষয়ে সচিব বলেন, আগে পাঁচ বছর অন্তর সম্পদবিবরণী দাখিলের নিয়ম ছিল। এখন তা প্রতিবছর করা হয়েছে। প্রয়োজনের নিরিখে সরকার যে কোনো নিয়মাবলি সময়ে সময়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের এখতিয়ার সংরক্ষণ করে। এরই আলোকে এখন বছরভিত্তিক করা হয়েছে।

সিনিয়র সচিব বলেন, সম্পদবিবরণী জমা দেওয়ার বিষয়ে একটি ফরম বা ছক তৈরি করা হয়েছে। ক্যাডার বা নন-ক্যাডার (নবম বা তদূর্ধ্ব গ্রেড) কর্মকর্তা তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিবের কাছে সম্পদবিবরণী দাখিল করবেন। আর গেজেটেড বা ননগেজেটেড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (দশম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড) নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হবে। সম্পদের বিবরণী সিলগালা খামে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদবিবরণী জমা দিতে ব্যর্থ হলে অথবা কোনো ভুল তথ্য বা তথ্য গোপন করলে বা সম্পদের কোনোরূপ অসংগতি দেখা গেলে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কী ধরনের শাস্তি হতে পারে-এমন প্রশ্নে সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, মূলত অসদাচরণ হিসাবে লঘু বা গুরুদণ্ড দেওয়া হয়। লঘুদণ্ড কয়েক ধরনের হতে পারে যেমন : তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিত এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ বা আনুতোষিক থেকে তা আদায় করা অথবা বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে নামিয়ে দেওয়া (অবনমিতকরণ)। গুরুদণ্ড হচ্ছে যেমন : নিম্নতর গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা। সচিব বলেন, প্রথমে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। তারপরও লঘুদণ্ডের চেয়ে অতিমাত্রায় অপরাধ হলে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়।

প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন কারও বিরুদ্ধে মামলা বা অভিযোগ হলে তখন আর এ তথ্য গোপনীয়তার মধ্যে থাকবে না। আয়করযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিবছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়কর বিবরণী জমা দেন, যেখানে সম্পদের বিবরণীও উল্লেখ করার বিধান রয়েছে। তাহলে বিষয়টি সাংঘর্ষিক কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন আয়কর রিটার্ন দাখিলের সঙ্গে সব সরকারি কর্মচারীর সম্পদবিবরণীর সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ সব কর্মচারীকে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। এখন ম্যানুয়ালি নেওয়া হলেও একপর্যায়ে তা অনলাইনে জমা দিতে হবে। অনলাইনে যখন নেওয়া হবে, তখন কারও সম্পদ অবিশ্বাস্য হলে যন্ত্রই সংকেত দেবে। অনলাইনে সম্পদবিবরণী নেওয়া হলে যাচাই-বাছাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে।

এখন কীভাবে সম্পদ হিসাব যাচাই হবে-এমন প্রশ্নে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, কেউ সম্পদ গোপন করে রাখতে পারবে না। একজনের পেছনে একজন লাগা আছে। কেউ গোপন করলে তা আর গোপন থাকবে না। এমনিতেই বেরিয়ে যাবে।

সম্পদবিবরণীর ফরমে কর্মচারীর নাম, পরিচিতি নম্বর, পদবি, ক্যাডার, বর্তমান কর্মস্থল, চাকরিতে যোগদানের তারিখ, যোগদানকালে পদবি, স্থায়ী ঠিকানা, এনআইডি নম্বর, জম্ম তারিখ, টিআইএন নম্বর, বেতন স্কেল, মূল বেতন, মোবাইল নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে।

স্থাবর সম্পদ হিসাবে কৃষি ও অকৃষি জমি, ইমারত, বসতবাড়ি, ফ্ল্যাট, খামারবাড়ি বা বাগানবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদের বিবরণ থাকতে হবে। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে অলঙ্কারাদি, স্টক, শেয়ার, ডিভেঞ্চার, বন্ড, সিকিউরিটিজ, সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড, সঞ্চয় স্কিম, বিমা, নগদ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, ঋণ প্রদানকৃত অর্থ, এফডিআর ও ডিপিএস, জিপিএফ, সিপিএফ, মোটরযান ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক, আগ্নেয়াস্ত্র এবং অন্যান্য সম্পদবিবরণী দাখিল করতে হবে। হাতে লিখে অথবা কম্পোজ করে নির্ধারিত ছকে উপস্থাপন করা যাবে। যৌথ মালিকানায় অর্জিত সম্পদ ও দায়ের ক্ষেত্রে অংশ মোতাবেক প্রাপ্য সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য উল্লেখ করতে হবে। কর্মচারীর ওপর নির্ভরশীল নয়-এমন সন্তান বা সন্তানদের সম্পদ উল্লেখ করা যাবে না।

পূর্বের খবরএবার প্রকাশ্যে ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সিবগাতুল্লাহ
পরবর্তি খবরযেসব কারণে এবারের জাতিসংঘ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ