এ বছরের পাঁচই জুন যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয়, তখন কারো ধারণাই ছিলো না যে পরের দুই মাসের মধ্যে সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটবে। শেষ পর্যন্ত এটি শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের টানা শাসন অবসানের দিকে নিয়ে গেছে।
সেদিন হাইকোর্টের সেই আদেশটি অনেক পত্রিকায় তেমন গুরুত্বও পায়নি। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহের মাথায় সেই বিক্ষোভের জেরে এক সময় ১৬ বছর ধরে কঠোরভাবে বিরোধী দলকে দমন করে একটানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনাকে গোপনে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়।
আন্দোলনটি শুরুতে ছাত্রদের কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এর সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার, নানা বয়সের লাখো মানুষ অংশ নিতে শুরু করে।
লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ যাকে ‘গণবিদ্রোহ’ বলে বর্ণনা করছেন।
তিনি বলছেন, ”শেষ পর্যন্ত এটা শুধু কোটা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। একপর্যায়ে দেশের সব স্তরের মানুষ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, বা সমর্থন দিয়েছে,” বলছিলেন মি.আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে নানা কারণে ক্ষোভ জমছিল। সেই ক্ষোভ বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ একটা সুযোগ খুঁজছিল।
”কোটা সংস্কার আন্দোলনটা তাদের একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল। তারা সেই আন্দোলনকে ঘিরে নিজেদের ক্ষোভ, এতদিনের চাপা বেদনার প্রকাশ ঘটিয়েছে,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছিল, প্রায় ৫০ বছরের মাথায় দলটি আবার সেই একই অবস্থায় পড়েছে।
কিন্তু পুরো পরিস্থিতি কীভাবে এবং কেন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছালো, যাতে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির বিরুদ্ধে এভাবে রাজপথে নেমে আসলো?
কেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হলো?
দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে আর দলটি ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি।
একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে দলটির টিকে থাকা এই পতনের পেছনে মূল কয়েকটি কারণ হিসেবে উঠে আসছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ”এই ১৫ বছরে বেশিরভাগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তারা নিজেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের যে ক্ষমতার ভিত্তি, তার কোনটাই টেকসই ছিল না। কারণ তারা জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন।”
”ফলে মানুষের একটা ক্যাটালিস্ট বা স্ফুলিংগের দরকার ছিল। সেটাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দিয়ে শুরু হয়েছে, তিনি বলছেন।
ফলে সরকার বিরোধী একটা আন্দোলন যখন জোরালো হয়ে ওঠে, সেই আন্দোলন ঘিরেও মানুষের ক্ষোভের জন্ম হয়, তখন সেনাবাহিনী, কারফিউ বা পুলিশের পরোয়ানা না করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ গণভবনের উদ্দেশ্যে পথে নেমে এসেছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ”১৫ বছরের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, জিনিসপত্রের দাম, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, ব্যাংকিংয়ের অনিয়ম সব কিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ কোটা আন্দোলনের একটা উপলক্ষ্য করে একটা পরিবর্তনের আশায় নেমে এসেছে।”
সেই আন্দোলনে অংশ নেয়া তাহমিনা আক্তার বিবিসিকে বলেছিলেন, ”আমার সরকারি চাকরির দরকার নেই, চাকরির আবেদন করার মতো বয়সও নেই। কিন্তু আমাদের সাথে যে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, আমাদের যে ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হচ্ছে, সেটার অবসান চাই। সেটার জন্যই আজ আমি পথে নেমে এসেছি।”
গণঅভুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের পেছনে আরো কিছু কারণ দেখছেন বিশ্লেষকরা।
ভোটের আর মতপ্রকাশের অধিকার
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ বাস্তবে কার্যত একটি ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারে পরিণত হয়েছিল।
২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুইটি হয়েছে অনেকটা একতরফা নির্বাচন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও সেখানে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল, যে নির্বাচনকে ‘রাতের নির্বাচন’ বলেও অনেকে বর্ণনা করেন।
এমনকি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। সেসব নির্বাচনও বেশিরভাগ সময় একতরফা হয়েছে। যেখানে বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে, সেখানেই অনিয়ম বা কারচুপির অভিযোগ উঠেছে।
ফলে গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার বা মতামত জানানোর কোন অধিকার পায়নি।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ”আওয়ামী লীগ যেটা করেছে, জোরজবরদস্তি করে একটা কতৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করলো। জনগণের কোন রায় তারা নেয়নি। ফলে জনগণের সমর্থনও ছিল না তাদের পেছনে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জবরদস্তি করে ভুয়া নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় ছিল।”
আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী দলকে শক্ত হাতে দমন করার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
সব দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ শত শত নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে, মামলা বা সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ”যে দেশটা স্বাধীন হয়েছে মানুষের ভোটের অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, সেই দেশে দীর্ঘ ১৫ বছরে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ। তাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আইন, নজরদারি করার মাধ্যমে।”
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পুলিশের অনুমতি ছাড়া প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সভা সমাবেশও করতে দেয়া হয়নি।
মানবাধিকার হরণ ও ভয়ের সংষ্কৃতি
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এ বছরের শুরুতেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক অভিযোগ করেছিলেন যে, মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বিরোধী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিরুদ্ধ মত দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। বিরোধী গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, দখল নেয়া হয়েছে অথবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে।
বাংলাদেশে গত বহু বছর ধরে সামাজিক মাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিব বিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। এই দমনের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে।
সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়ার জের ধরে মাসের পর মাস ধরে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে, জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যেমন বলছিলেন, ”তারা একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছি। সাইবার সিকিউরিটির ভয় দেখানো, মিথ্যা মামলা দেয়া- মানুষজন একটা ভয়ের মধ্যে ছিল।”
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকার ও পুলিশ বাহিনী মিলে পুরো দেশকে একটা ‘মাফিয়া স্টেট’ তৈরি করেছিল।
আর এসবের জন্য সবসময়েই সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনী এমনকি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে।
যেসব মামলায় গত ১৬ বছরে জামিন হয়নি, সরকার পরিবর্তনের পর এক রাতের মধ্যে সেসব মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন এসব রাজনৈতিক দলের শত শত কর্মী। জামিন দেয়ার সময় বিচারক মন্তব্য করেছেন, ”অনেক কথা আছে যা আমরা বলতে পারি না।”
বছরের পর বছর বিরোধীদের ধরে নিয়ে হয় গুম করে দেয়া হয়েছে না হলে আটকে রাখা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এরকম কয়েকজন ব্যক্তি মুক্তিও পেয়েছেন, যাদের আট বছরের বেশি সময় ধরে কোন অভিযোগ ছাড়াই গোপনে আটকে রাখা হয়েছিল।
ফলে মানুষ যে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি, ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে, তা থেকে মুক্তি পেতেই গণআন্দোলনে সবাই নেমে এসেছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
”মানুষের মধ্যে দিনে দিনে সরকারের প্রতি বা আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ দানা বেধেছে। ফলে তাদের একটা উপলক্ষ্য দরকার ছিল রুখে দাড়ানোর,” বলছিলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
পুলিশ ও প্রশাসন নির্ভর একটি দল
বিভিন্ন দেশের ইতিহাসেও দেখা গেছে, জোর করে ক্ষমতায় থাকা দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এক সময় আমলা, প্রশাসন বা পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
তাদের মতে, টানা বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে এক সময়ের মাঠের রাজনৈতিক দল হলেও দলটির নেতা-কর্মীরা জনগণের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দলটি। বিশেষ করে দলটি পুরোপুরি প্রশাসন ও আমলানির্ভর হয়ে উঠেছিল।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব নেতাদের পদ দেয়া হতো, অভিযোগ রয়েছে যোগ্যতার বদলে বরং স্বজনপ্রীতি বা অর্থের বিনিময়ে এসব পদ দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক পদ বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন অনেক ব্যক্তিকে সুযোগ দেয়া হয়েছে যাদের অতীতে রাজনীতির সাথে কোন সংস্রব ছিল না। তাদের অনেকেই এসব পদকে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করেছে।
সাংবাদিকসহ পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে এমনভাবে দলীয় বিস্তার ঘটানো হয়েছে যাতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আসল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। ।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ”গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র শক্তি ব্যবহার করতে করতে তাদের দলটাকে দুর্বল করে ফেলেছিলেন। অযোগ্য, অদক্ষ ব্যক্তিদের দলের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। ফলে তাদের সব কিছু ছিল, কিন্তু দলটাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না।”
”প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে ছাত্রলীগ, যুবলীগের নামে, আওয়ামী লীগের নামে তাদের নেতাকর্মীরা যা করেছে, তাতে মানুষের ক্ষোভ জমতে জমতে এমন একটা অবস্থায় গেছে, এবার শুধু সেটার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। গুলিতে যখন অনেক মানুষ মারা গেছে, তখন তাদের গুলিতে মৃত্যুর ভয়ও চলে গেছে,” তিনি বলছেন।
সূত্রঃ সায়েদুল ইসলাম; বিবিসি নিউজ বাংলা।
এস/ভি নিউজ