যাত্রাবাড়ী এলাকার আবুল ফজল ৫ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন, সঙ্গে পেট খারাপ। শারীরিক অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষা করে জানা যায় তার ডেঙ্গু। তিনি এখন সেখানে চিকিৎসাধীন। পরিবার জানায়, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) থেকে ফজলের দুই মেয়েরও জ্বর। আবুল ফজলের মতো অনেকেই সেবা নিচ্ছেন হাসপাতালটিতে।
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৯৬৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১২২ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় চিকিৎসাধীন হলেও সম্প্রতি উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকাতেও ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
ঢাকার হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে শতাধিক রোগী বেড়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে ১৩১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। অর্থাৎ দৈনিক ১৮-২০ জন রোগী আসছেন। ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত শতাধিক রোগী চিকিৎসাধীন আছে পাঁচটি হাসপাতালে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ও ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল।
এছাড়া মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯৮ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৮৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন। ডেঙ্গু চিকিৎসায় আলাদা বেড আছে ঢাকার এমন ১৮টি সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন মোট রোগীর সংখ্যা ৮৫২।
ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ডেঙ্গুরোগী। ঢাকার বাইরে এক সপ্তাহ আগে ৬১৯ জন রোগী চিকিৎসাধীন থাকলেও বর্তমানে আছেন ১ হাজার ১৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজারে। সেখানে গত ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৪৮৬ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। হাসপাতালটি ঘুরে দেখা যায়, অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে মেঝেতেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জায়গা না হওয়ায় ওয়ার্ডের বাইরেও অতিরিক্ত বেড বসিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানান, জুলাই-অক্টোবর ডেঙ্গুর মৌসুম। সময়ের সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। গতকাল মুগদা হাসপাতালে ১০১ জন রোগী ভর্তি ছিল। তাদের মধ্যে ২৯ জন শিশু। মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম কম থাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। ফলে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এস এম হাসিবুল ইসলাম বলেন, মৌসুমে যেমন রোগী বাড়ে তেমনই বাড়ছে। তবে রোগীদের শারীরিক জটিলতা বেশি হচ্ছে। সাধারণত ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা। এবার আমরা দেখছি পেটের সমস্যা হচ্ছে, লিভারে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, এই মুহূর্তে শয্যার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ১০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর আগে সাধারণত ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি থাকতো ৩০ থেকে ৩৫ জন, কিন্তু এখন ৬০ থেকে ৭০। যেখানে ডেঙ্গুরোগীদের জন্য শয্যা আছে মাত্র ২০টি, বর্তমানে সেখানে ১৩৬ জন রোগী চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবু জাফরের ভাই মিলন জানান, শুরুতে ভাইয়ার টানা কয়েক দিন জ্বর ছিল। রক্ত পরীক্ষা করার পর ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তার প্লাটিলেট ছিল এক লাখের বেশি। বাসায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ অবস্থা খারাপ হতে থাকে, তাই মেডিক্যালে নিয়ে আসি। এখন আগের তুলনায় বেশ ভালো আছে।
হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ডের ভর্তি থাকা রোগীর চেয়ে দ্বিগুণ রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, আমাদের এখানে পুরুষের চেয়ে নারী ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বেশি। প্রতিদিনই ২০-৩০ জন নতুন রোগী আসছেন। তাই শয্যার চেয়েও রোগীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যেই আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া ১০৮ জনের মধ্যে ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ নারী এবং ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ। অর্থাৎ আক্রান্ত কম হলেও বেশি মারা যাচ্ছেন নারীরা।
এস/ভি নিউজ