দফায়–দফায় আইন সংশোধন করে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা গত সরকারের আমলে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের আবদার মেনে তাদের আজীবন পরিচালক থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। একই ব্যক্তি বা গ্রুপের মালিকানার এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে আরেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি না করা এবং এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে পাঁচজন পরিচালক থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। অন্তবর্তী সরকারের ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগে এ জাতীয় সুবিধা খর্ব করতে বিভিন্ন পর্যায় থেকে সুপারিশ আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব সুপারিশ পর্যোলোচনা করছে।
বেশ আগ থেকে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বিতর্কিত বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে ভেতরে–ভেতরে কথা বলছিলেন। এখন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নতুন নেতৃত্ব ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ আর্থিক খাতের অন্যান্য আইন শক্তিশালী করার সুপারিশ করেছেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্তিশালী আইন ও ব্যাংকের পর্ষদে পারিবারিক আধিপত্য কমানোর কথা বলেন। বিগত সরকারের সময়ে বির্তকিত সব সংশোধনী হয়েছিল নজরুল ইসলাম মজুমদার বিএবির নেতৃত্বে থাকা অবস্থায়। এ ধরণের দাবি আদায়ের বিষয় এসে সব ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে মোটা অংকের অর্থ জোগানের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের যেসব ধারা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তা সংশোধন করা হবে। এখনই না করে, ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত কমিশনের সুপারিশ এবং তাদের মতামতের ভিত্তিতে হবে। এজন্য কোথায় কি সমস্যা আছে চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। তবে আইন সংশোধনে কিছুটা সময় লাগলেও নৈতিক অবস্থান থেকে বিতর্কিত কোনো বিষয়ে তারা অনুমোদন দেবেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বিগত সরকারের সময়ে মোটাদাগে তিন নির্বাচনের আগে ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের আগস্টের সংশোধনী হয় মূলত আইএমএফের ঋণ পাওয়া যেন সহজ হয়, সে জন্য খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন কঠোর করার লক্ষ্য সামনে রেখে। যেখানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মত না নিয়ে গত বছরের ২১ আগস্ট এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে আরেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি না করা এবং টানা ১২ বছর পরিচালক থাকার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। বিল পাশের ঠিক আগ মুহুর্তে এ দু’টি সংশোধনী আনা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার পর ব্যাংক কোম্পানি আইনের সর্বশেষ সংশোধনীর প্রস্তাব বিল আকারে সংসদে উঠেছিল ২০২৩ সালের ৮ জুন। পরদিন ৯ জুন ছিল বিএবি আয়োজিত শেখ হাসিনা আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই অনুষ্ঠানে বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এক প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে আরেক প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি না দেখানো এবং টানা ১২ বছর পরিচালক থাকার সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৩ সালের সংশোধনীতে ১৫(১০) উপধারায় যুক্ত করে বলা হয় এক পরিবার থেকে দুইজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না। ১৫কক ধারায় বলা হয়, কোনো পরিচালক টানা দুই মেয়াদের বেশি পরিচালক থাকবে না। তবে ২০১৮ সালে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা ৯ বছর পরিচালক থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে আরও শিথিল করে টানা ১২ বছর পরিচালক এবং কৌশলে এক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ৫জন পরিচালক থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। কৌশলটি ছিল এমন– ১৫(১০) বলা হয়েছে, একপরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজনের বেশি পরিচালক থাকবে না। তবে আইনের ২৩(কক) ধারা যুক্ত করে বলা হয়েছে– একক পরিবারের সদস্যের অতিরিক্ত ২টি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক থাকতে পারবে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ কমাতে হলো শক্তিশালী আইনি কাঠামো দরকার। একই সঙ্গে পরিবারতন্ত্র মুক্ত করা দরকার। এ জন্য বিতর্কিত ধারাগুলো দ্রুত সংশোধন এবং বিভিন্ন নীতিমালার সংস্কার করা দরকার।
২০২০ সালের নভেম্বরে কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক ব্যক্তির কোম্পানি খোলার সুযোগ যুক্ত করা হয়। আগে একটি কোম্পানি খোলার জন্য চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ একটি পর্ষদ গঠন ও কার্যপরিধি থাকতে হতো। এক ব্যক্তির কোম্পানির মাধ্যমে বেনামি ঋণের সুযোগ বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন।