শীতের শুরুতেই গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানা

চট্টগ্রামে ছোট-বড় এক হাজার ২০০ কারখানায় গ্যাস সরবরাহ দিচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। জিপিএইচ ইস্পাত, বিএসআরএম, একেএস, কেএসআরএম, গোল্ডেন ইস্পাত, এইচএম স্টিল, বায়েজিদ স্টিলসহ চট্টগ্রামে রয়েছে ইস্পাত শিল্পের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই। এখানে আছে সিইউএফএল, কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানিসহ সার উৎপাদনকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। সিমেন্ট উৎপাদন করা ৯-১০টি প্রতিষ্ঠানের কারখানাও আছে চট্টগ্রামে।

আছে পাঁচ শতাধিক গার্মেন্ট কারখানা ও কাঁচ উৎপাদন করা শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। বন্দর নগরীতে তাই মোট গ্যাসের চাহিদা থাকে ৩০ থেকে ৩২ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে শিল্পকারখানায় গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ৮ থেকে ১০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এ চাহিদার সব গ্যাস নিরবচ্ছিন্নভাবে পাচ্ছে না শিল্পকারখানার মালিকরা। চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকছে প্রায় ৩০ শতাংশ গ্যাস। এ কারণে মাঝারি ও ভারী শিল্পকারখানার উৎপাদনও প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।
শুধু শিল্পকারখানা নয়, আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকরাও ভুগছেন গ্যাস সংকটে। শীত এলে প্রতি বছর ঘনীভূত হয় এ সমস্যা। চট্টগ্রামে একই লাইন থেকে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ করে কেজিডিসিএল। শিল্পকারখানা ও আবাসিক এলাকায় কী পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করে সেটি আলাদাও করতে পারে না তারা। কর্তৃপক্ষের ধারণা, শিল্পে অন্তত পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস যাচ্ছে চট্টগ্রামে। এখন এলএনজির মাধ্যমেই চট্টগ্রামে গ্যাসের সব চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে।

কেজিডিসিএলের হাতে নেই বিকল্প কোনো ব্যবস্থা। অথচ গত ৬ মাসে একাধিকবার এমন গ্যাস সংকটের মুখোমুখি হয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। এবারের শীতে এ সংকট আবার আসার আভাস এখনই পাচ্ছেন ৬০ লাখ নগরবাসী। তবে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংকট আছে বলে স্বীকার করেনি সমকালের কাছে। প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, ‘শীত এলে কিংবা এলএনজির সরবরাহ প্রক্রিয়াতে বিঘ্ন ঘটলে কখনও কখনও গ্যাসের চাপ কম থাকে।

তবে এ মুহূর্তে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের জোগান ঠিক রয়েছে। তারপরও যদি গ্যাসের জোগানে কোথাও ঘাটতি থাকে, সেটি খোঁজখবর নিয়ে দেখব আমরা।’
জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‘শীত এলে প্রতি বছর গ্যাস সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। রড তৈরির রোলিং মিলে গ্যাস লাগে। আবার রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট উৎপাদন করতে গিয়েও দরকার হয় গ্যাসের। এটির জোগান ঠিকমতো না পেলে সমস্যায় পড়তে হয় আমাদের।’

ইস্পাত খাতের আরেক শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ‘বাণিজ্যিক রাজধানীর শিল্পকারখানা টিকিয়ে রাখতে হলে এটির বিকল্প ভাবতে হবে দায়িত্বশীলদের।’
গ্যাস সংকটে উৎপাদন কার্যক্রম কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার উদাহরণ টেনে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরোয়ার আলম বলেন, ‘চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মাঝারি আকারের রড কারখানা গোল্ডেন ইস্পাত লিমিটেড রয়েছে আমাদের। প্রতিদিন ৬০০ টন রড উৎপাদন সক্ষমতার এই কারখানা গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়ে আগের তুলনায় এখন ৩০ শতাংশ পণ্য কম উৎপাদন করছে। দিনের বেলায় সংকট তীব্র হচ্ছে বেশি। প্রতি ঘণ্টায় গ্যাসের যে চাহিদা থাকার কথা সেটি প্রায় ৩০ শতাংশ কম পাচ্ছি।

আবার বিদ্যুৎ কম পাচ্ছি চাহিদার প্রায় অর্ধেক। লোড ক্যাপাসিটি ঠিক রাখতে আমাদের এ কারখানায় ১৫ মেগাওয়াট স্বতন্ত্র লাইন স্থাপন করা আছে। কিন্তু রোববার আমাদের বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে ৮ মেগাওয়াট। সোমবার পেয়েছি ৬ মেগাওয়াট। দিনের বেলায় একবার বিদ্যুৎ গেলে ৩-৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে কমে যাচ্ছে উৎপাদন। বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়।’
তিনি জানান, রড উৎপাদনের চুল্লি গরম করতে সাধারণত ৪০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনের বেলায় ৩-৪ গুণ বেশি সময় লাগছে। এই কারখানা ছাড়াও আনোয়ারায় এইচএম স্টিল নামে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের আরেকটি রড উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে।  দিনে এক হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতার সেই কারখানায় সক্ষমতার ৫০ শতাংশ ব্যবহার করছেন তারা। ইস্পাতের মতো সিমেন্ট ও কাচ শিল্পেও গ্যাস সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘সিমেন্ট শিল্পে গ্যাস জেনারেটর চালু রাখতে এবং কাঁচামাল স্ল্যাগ শুকানোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দরকার। চাহিদা মতো গ্যাস না পেলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।’ তিনি জানান, চট্টগ্রামে বর্তমানে ৯-১০টি সিমেন্ট কারখানা চালু রয়েছে।
একটি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রির মালিক বলেন, ‘আমাদের চুল্লি চালু রাখতে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস দরকার। গ্যাসের চাপ কম থাকলে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়।’
ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের নভেম্বর থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। জানুয়ারিতে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায়। তখন শিল্পকারখানার পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন ও আবাসিক এলাকার গ্রাহকরাও চরম ভোগান্তিতে পড়তে থাকেন। এ বছরও নভেম্বরের আগ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে গ্যাসের সংকট। শীত যত ঘনিয়ে আসবে এ সংকট আরও তীব্র হবে বলে মনে করছেন সিএনজি স্টেশনের মালিকরাও।
নগরের আন্দরকিল্লা, লাভ লেন, কাজীর দেউড়ি, কাতালগঞ্জ, আসকার দীঘিরপাড়, হিলভিউ, এনায়েতবাজার, ওয়াসা, দুই নম্বর গেট, হামজারবাগ, মুরাদপুর, রৌফাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা শীত এলে গ্যাসের সংকটে ভুগেন। প্রসঙ্গত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। সেখানে সরবরাহ প্রক্রিয়ায় সমস্যা হলে কিংবা পাইপলাইনে বিঘ্ন ঘটলে সেটির প্রভাব চরমভাবে পড়ে চট্টগ্রামের আবাসিক ও শিল্প এলাকায়। জানা গেছে, চট্টগ্রামে কেজিডিসিএলের গ্রাহক সংযোগ ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি, বাকিগুলো শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে।
জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে সংযুক্ত রাখার দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ী ও স্টেকহোল্ডাররা। এ সময় বর্ধিত গ্যাসের দাম কমানো ও জামানত স্থগিতের দাবিও জানানো হয়। গত বছর গ্যাস সংকট তীব্র হলে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএলএক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী ও স্টেকহোল্ডারা এ দাবি জানান। চট্টগ্রামকে পুরোপুরি এলএনজিনির্ভর করে রাখায় মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তারা। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান। তিনি বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে তখন আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, আগের অবস্থাতেই আছে চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ লাইন।

এস/ভি নিউজ

পূর্বের খবরআমার বাবা ছিলেন স্বৈরাচারী, কিন্তু আমি একেবারেই আলাদা: আয়ুষ্মান
পরবর্তি খবরচব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিন : জামায়াত আমির