রাজনৈতিক কারণেই কি পাঠ্যপুস্তকে বারবার হাত!

বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেন শেষ হয় না৷ সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই একই সরকারের আমলেও একাধিকবার পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হয়েছে।

কখনো চেষ্টা হয়েছে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরির, কখনও বা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো সাজানো হয়েছে বই৷ শিক্ষক, শিক্ষবিদ বা শিক্ষার্থীদের মতামত কখনই আমলে নেওয়া হয়নি৷

কেন বারবার বদলাতে হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক? কেন সবাই একমত হতে পারেন না? এ বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখা গেল, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর আপত্তিতে অনেকবার বদলেছে পাঠ্যবই৷ আবার শিক্ষাবিদরাও কোন কোন ক্ষেত্রে দিয়েছেন আপত্তি৷ ফলে দুই পক্ষ কখনই একই বিষয়ে একমত হতে পারেনি৷ সেটা হতে পারার কথাও না৷ তাহলে কি এভাবেই বারবার বদলে যেতে থাকবে পাঠ্যবই?

কিছুদিন আগে আলাপকালে ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছিলেন, আমাদের আসলে গোড়াতেই গলদ৷ শুধু পাঠ্যবই না, শিক্ষানীতিও ঠিক নেই৷ আগে যে পাঠ্যবইগুলো ছিল সেগুলো যথেষ্ট মানসম্পন্ন ছিল৷ হ্যাঁ, যুগের প্রয়োজনে কিছু সংযোজন হতে পারে৷ কিন্তু আগের ওইগুলো বাদ দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন? আসলে যারা এগুলো করছে, তারা নিজেরাও জানে না কেন করছে? এসব করে দিন দিন আমরা পেছনে চলে যাচ্ছি৷

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপস্তুক বোর্ড বা এনসিটিবি’র তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এসেছে সাতবার৷ এবারের পরিবর্তন হলে হবে আটবার৷ ১৯৭৭ সালে প্রথম শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর ১৯৮৬ সালে পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন করা হয়৷

১৯৯২ সালে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে রূপান্তর করা হয়, ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক স্তরে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন করা হয়৷ পরে ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের কিছু পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন করা হয়৷ এরপর ২০১২ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়৷ প্রায় এক দশক পর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে সেটিও পরিবর্তন করা হয়৷ এসব পরিবর্তনে কি সুফল মিলেছে?

২০১২ সালে শিক্ষাক্রমে যখন পরির্বতন আনা হয়েছিলো তখন এমসিকিউ বাদ দিয়ে সৃজনশীল যুক্ত হয়েছে৷

পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসঙ্গতির মাত্রা সবসময়ই ছিল৷ বরং নব্বইয়ের দশকের আগে যে পাঠ্যবইগুলো ছিলো সেখানে বরং ভুল কম ছিল৷ এরপরই পাঠ্যবইয়ে ভুল বাড়তে থাকে৷ আগের পাঠ্যবইয়ে ভুল বিকৃতি অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে বিশিষ্ট শিক্ষা ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন উদয়ন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী৷ তার দায়িত্ব পড়েছিল নবম দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য বইয়ের ভুল ও অসঙ্গতি তুলে ধরার৷ যে সমস্ত ভুল তিনি পেয়েছিলেন তাতে পাঠ্যবই প্রস্তুতে উদাসীনতা আর অজ্ঞতা অনেক বড় করে ধরা পড়েছে তার কাছে৷ তিনি বলেন, উদাসীনতা এবং অযোগ্যতা নিশ্চয়ই ছিল৷ নাহলে এত ভুল কেন হবে? হাস্যকর সব ভুল৷ ২৬২ পৃষ্ঠার বইতে প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় ভুল আর অসঙ্গতি৷ যত্ন আর মনোযোগের অভাব৷ সেসঙ্গে যারা লিখেছেন তারা হয়তো ভালো বানান জানেনই না৷

এবার আলোচনা করা যাক পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত বিষয় নিয়ে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএম আকাশ এক মন্তব্যে বলেছেন, পাঠ্যবই বারবার পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক কারণই সবচেয়ে বড়৷ তার মতে, পাঠ্যবই তৈরির ক্ষেত্রে একধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রভাব তার নজরে পড়ে৷ যার ফলে তাদের রক্ষণশীল চিন্তাধারার প্রভাব পড়ছে বইয়ের পাতায়৷ হেফাজতে ইসলামমের দাবির পেক্ষিতে আগের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনতে হয়েছে৷ ফলে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে ভোটের রাজনীতির প্রভাব যতক্ষণ পর্যন্ত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত পাঠ্যবইকে ঘিরে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে না বলেই তার মত৷

আগের পরীক্ষাপদ্ধতি বাদসহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনে গত শিক্ষাবর্ষ থেকে বাংলাদেশে নতুন যে কারিকুলাম চালু হয় তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই৷ শিক্ষক ও অভিভাবকরা নতুন ওই কারিকুলাম নিয়ে উদ্বেগের কথা জানালেও সরকার বলছে, নতুন বিধায় এটি বুঝতে সময় লাগছে৷ শিক্ষকদের অনেকে বলছেন, নতুন এ পদ্ধতি বোঝার জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার তা সঠিকভাবে দেওয়া হয়নি৷ এর ফলে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই আছে অন্ধকারের মধ্যে৷ অন্যদিকে নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতি পুরোপুরি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর এ নিয়ে আপত্তি তোলেন অভিভাবকরা৷

বিদায়ী সরকার তখন বলছে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে প্রস্তুত করতে এই উদ্যোগ তাদের৷ মুখস্ত করার প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসে এক দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তুলতে তারা এই শিক্ষাক্রম চালু করেছে৷ কিন্তু দফায় দফায় কারিকুলামে এরকম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার ওপর, শিক্ষার্থীদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে? একজন শিক্ষক আলাপকালে বলছিলেন, আমরা যারা পড়াচ্ছি, আমাদের কাউকে কাউকে নামমাত্র একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান করতে৷ আমাদের অবস্থা হয়েছে ঢাল তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দারের মতো৷ প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে৷

ওই পাঠ্যক্রম নিয়ে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরীক্ষা পদ্ধতিসহ নানা কারণে অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্যায় শেষ করলেও মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করতে পারছে না৷ দেশে প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী প্রাথমিক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হচ্ছে৷ কিন্তু এসএসসি পাশ করছে মাত্র ২০ থেকে ২৩ লাখ শিক্ষার্থী৷ মাঝপথে এসব শিক্ষার্থী সেই পুরানো পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে ঝরে পড়ছিল৷ আমরা তাদের স্কুল ও পড়াশোনায় ধরে রেখে দক্ষ করে গড়ে তুলতে চেয়েছি৷ এ কারণেই নতুন কারিকুলামে কার্যকরী বলে মনে করতেন তারা৷

একটা অভ্যুত্থানের পর এসেছে নতুন সরকার৷ গত ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. খ. ম. কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমানকে সদস্য সচিব করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ কমিটি গঠনের ১৩ দিনের মাথায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ ওই কমিটি বাতিল করা হয়৷ এই সরকারের আমলে গঠিত কমিটি কেন বাতিল করতে হলো?

অধ্যাপক এমএম আকাশের ওই মন্তব্যই আরেকবার স্মরণ করা যায়৷ তার মতে, পাঠ্যবই বারবার পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক কারণই সবচেয়ে বড়৷ পাঠ্যবই তৈরির ক্ষেত্রে একধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রভাব তার নজরে পড়ে৷

ঘটনাটিও ঠিক তাই৷ ২৬ সেপ্টেম্বর জামালপুরে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘‘সরকারকে বলতে চাই শিক্ষা কমিশন নামে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে এর মধ্যে সমকামিতার প্রোমোটকারী যারা রয়েছে, তাদেরকে শিক্ষা কমিশন থেকে বাদ দিন৷ ইসলামী শিক্ষাবিদ, আলেম, ওলামাদের প্রতিনিধি সেখানে অন্তর্ভুক্ত করুন৷ এটা আমাদের অধিকারের কথা৷ আজ জেলা শহরের মঞ্চ থেকে বলছি, কয়েকদিন পর ঢাকা থেকে বলব৷ এরপর শাপলা চত্বরে যাব, এরপরও যদি আমাদের কথা কর্ণপাত না করা হয় তাহলে গণভবন-বঙ্গভবন কোনো কিছুই ছাড়বো না৷’’

এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘বর্তমান শিক্ষা সংস্কার কমিশন ছেঁটে আস্তিক ও আগস্ট বিপ্লবের চেতনাধারীদের বসাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই৷ আমরা ইতোমধ্যেই কিছু অসুবিধা দেখতে পাচ্ছি৷ শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে৷ কিন্তু এই দেশের ৯০ ভাগ মানুষ আস্তিক৷ তাহলে আস্তিকদের প্রতিনিধিত্ব নেই কেন সেখানে? যারা এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনাই বুঝতে পারে না, তাদের কেন বসতে দেওয়া হয়েছে? আমরা চাই, তাদের এখান থেকে সাফ করে দেওয়া হোক৷ এই জাতির ঘাড়ে তাদের বসতে দেওয়া যাবে না৷’’

এরপরই দেখা গেল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই কমিটি বাতিল করেছে৷ অর্থাৎ, ইসলামপন্থি রাজনৈতিকদের হুমকিতে পিছু হটল সরকার৷ এ কারণে টিআইবি পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি বাতিলকে ‘মৌলবাদের কাছে সরকারের নতি স্বীকার’ হিসেবে দেখছে৷ তারা একটা বিবৃতিও দিয়েছে৷ তবে কমিটির একজন সদস্য আলাপকালে বলছিলেন, তারা যে সুপারিশ করতে যাচ্ছিলেন সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের কথা তারা আলোচনা করেছিলেন৷ এই আলোচনার কথা হয়ত ইসলামপন্থী নেতাদের কানে গিয়েছিল৷ সে কারণেই হয়ত তারা হুমকি দিয়েছিলেন৷

দিন শেষে যাই হোক না কেন, পঠ্যপুস্তকে কোন পরিবর্তনই এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি৷ এটা সম্ভব হবে না ততক্ষন পর্যন্ত যতক্ষন না পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে ভোটের রাজনীতির প্রভাব থাকবে৷

সূত্রঃ ডয়চে ভেল

এস/ভি নিউজ

পূর্বের খবরপাচারের অর্থ ফেরত পেতে আন্তর্জাতিক সংস্থার দিকে তাকিয়ে দুদক
পরবর্তি খবরদুর্গাপূজায় কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা