মার্কিন পদক্ষেপ ইসরায়েলকে আরও বিপদে ফেলছে

রামি জি খৌরি

বৈরুত ও তেহরানে হিজবুল্লাহ ও হামাসের সিনিয়র নেতা এবং কয়েকজন ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ১ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে। এ হামলার আগেই তার মিত্র ইসরায়েলকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে উল্লেখযোগ্য সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ছোড়া ১৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেটি গত কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রক্ষা করতে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বারবার হস্তক্ষেপ করেছে।
তবে, মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ তাদের ভাবনার বিপরীত কাজও করছে। এতে ইসরায়েল আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং আমেরিকান সামরিক শক্তির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হচ্ছে। এই ধারা ইসরায়েলকে ইহুদিদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাতে পরিণত করেছে।

এর কারণ হলো সামরিক শক্তির ব্যাপারে মার্কিন-ইসরায়েলি পক্ষপাত এই অঞ্চলে উত্তেজনার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করার কাজ বাধাগ্রস্ত করেছে– প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিন-জায়নবাদী সংঘাতই এ সমস্যার মূল। এটি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন নতুন সামরিক শক্তি ও জনপ্রিয় প্রতিরোধগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। হিজবুল্লাহ, হামাস, আনসার আল্লাহসহ (হুতি) অন্যরা এখন নিয়মিতভাবে মার্কিন ও ইসরায়েল দুটিকে আক্রমণের নিশানা বানিয়েছে।

বর্তমানে ইসরায়েলবিরোধী জোটের শক্তি কেবল তার অস্ত্র নয়, আরব জনমতের মধ্য থেকেও তৈরি হচ্ছে। এটি সামরিকভাবে ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং আরবদের পরাধীনতাকে প্রতিহত করতে ইচ্ছুক এবং সে সক্ষমতাও তারা রাখে, যা ১৯৭৩ সালের পর থেকে কোনো আরব রাষ্ট্র করেনি।

ইসরায়েলের জন্য ওয়াশিংটনের দ্রুত ও ব্যাপক সামরিক সমর্থন সহিংসতার চক্র স্থায়ী করে, যা গাজা ও লেবাননে যুদ্ধবিরতি কমিয়ে আনা ও যুদ্ধবিরতির যে প্রত্যাশা আছে তার বিরুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্যের খুব কম লোকই ওয়াশিংটনের কথা গুরুত্ব সহকারে বিশ্বাস করে। কারণ তাদের কার্যকলাপ সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ধারাবাহিকভাবে এটাই স্পষ্ট করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, হুমকি ও সামরিক গঠন এই অঞ্চলে বাস্তব বা কল্পিত শত্রুদের সঙ্গে লেগে থাকতে তাদের পছন্দের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ক্রমাগত দানা বাঁধছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের প্রয়োজন হচ্ছে না, স্বেচ্ছায় এখানে যোগ দিয়েছে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ পছন্দ করে এবং ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে যেতে তাদের আপত্তি নেই। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

কারণ, আমেরিকান রাজনীতিবিদরা বোঝেন যে, এটি অর্থনীতি চাঙ্গা করে। মার্কিন প্রতিরক্ষা বাজেট এখন প্রায় ৮৫০ বিলিয়ন ডলার। বছরে ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। দেশজুড়ে যুদ্ধ শত শত বড় ও ছোট কোম্পানির জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয়, বিনিয়োগ, চাকরি ও মুনাফা বাড়িয়ে তোলে, যাদের বেশির ভাগই প্রতি দুই বছরে নির্বাচিত কর্মকর্তাদের প্রচারণায় উদারহস্তে দান করে।

এ পর্যন্ত ওয়াশিংটন ইয়েমেনে আনসারুল্লাহর ওপর বোমা ফেলতে ১.৮ বিলিয়ন থেকে ৪ বিলিয়ন খরচ করেছে। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটি লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে চলমান জাহাজের ওপর অনবরত হামলা করছে। এপ্রিলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিষ্ক্রিয় করতে ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ ও ফরাসিদের সম্মিলিত অভিযানে খরচ হয়েছে আনুমানিক ১.১ বিলিয়ন। ১ অক্টোবরের সামরিক প্রতিক্রিয়া সম্ভবত সমানভাবে ব্যয়বহুল ছিল। কিছু আরব দেশও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করেছিল, কারণ ইসরায়েল একা আর নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ মেশিনের খোরাক জোগাতে এবং তা প্রদর্শন ছাড়াও অন্যান্য কারণে ইসরায়েলের জন্য যুদ্ধে যেতে পছন্দ করে। দেশটির সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কগুলো আংশিকভাবে স্নায়ুযুদ্ধের একটি দীর্ঘ ঘটনার বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র গোষ্ঠীর হাত থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষার ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে প্রধান সহযোগী হিসেবে দেখা হতো। স্নায়ুযুদ্ধের পর ওয়াশিংটন তেল আবিবকে একটি কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখতে থাকে, যা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

মার্কিন রাজনীতি ইসরায়েলি প্রচার, লবি গ্রুপ, মেসিয়ানিক খ্রিষ্টান, ইসরায়েলপন্থি মূলধারার সংবাদমাধ্যম ও অন্য একাধিক শক্তি দ্বারা গঠিত, যারা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষায় সামরিক পদক্ষেপের সুবিধাও জোগান দেয়।
প্রকৃতপক্ষে সত্যিকারের শান্তি প্রচেষ্টায় বিনিয়োগ করা সহজ ও অধিক ন্যায়সংগত, কম ব্যয়বহুল এবং আমেরিকান সৈন্যদের মাধ্যমে বর্তমান ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি স্থায়িত্ব দেওয়ার চেয়ে অনেক কম ধ্বংসাত্মক হবে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এটাই সবচেয়ে ভালো এবং সম্ভবত একমাত্র উপায়।

রামি জি খৌরি: আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের বিশিষ্ট ফেলো; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম।

এস/ভি নিউজ

পূর্বের খবরLebanon state media says ‘very violent’ Israeli strikes hit south Beirut
পরবর্তি খবরভারত ভিসা কমিয়ে দেওয়ায় সংকটে ইউরোপগামী ছাত্ররা