বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর। গত এক মাসে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি দুই-ই কমেছে। দুই দেশের বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, জুলাই মাসের চেয়ে আগস্ট মাসে বেনাপোল দিয়ে আমদানি কমেছে সোয়া তিন কোটি কেজির বেশি। একই সঙ্গে রপ্তানি কমেছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ কেজি। আখাউড়ায় কমেছে ৬৮১ টন। হিলি বন্দর দিয়ে আমদানি নেমেছে অর্ধেকে। অন্য বন্দরগুলো দিয়েও আমদানি-রপ্তানি কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো দেশের পক্ষ থেকেই বাণিজ্য বন্ধ বা নিরুৎসাহিত করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ কারণে আমদানি-রপ্তানি কমছে। আবার আন্দোলনের কারণে সরবরাহ চেইন নির্বিঘ্ন ছিল না। তা ছাড়া এই সময়টায় মৌসুমি কিছু পণ্যের আমদানি কিছুটা কম হয়।
দেশে চালু স্থলবন্দর ১৬টি। এসব বন্দর দিয়ে বছরে দেড় থেকে পৌনে দুই কোটি টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছর স্থলপথে দু’দেশের মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় ১ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৩ টন পণ্য। এ সময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৮ টন পণ্য। অর্থাৎ প্রায় ৯৪ শতাংশই ভারতের অনুকূলে। ভারত থেকে আমদানি হয় এমন পণ্যের তালিকায় রয়েছে তুলা, সুতা, বস্ত্র, শিল্পের বিভিন্ন রাসায়নিক, পাথর, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, সব ধরনের মসলা, বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফল। অন্যদিকে রপ্তানি তালিকায় রয়েছে তৈরি পোশাক, কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য, মাছ, শুঁটকি, বর্জ্য তুলা, সিমেন্ট, মেলামাইন সামগ্রী, পিভিসি পাইপ, পিভিসি ডোর, জুস, ফার্নিচার ও প্লাস্টিক সামগ্রী। পণ্য বাণিজ্য ছাড়াও গত বছর দু’দেশের ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ২৩৮ যাত্রী আসা-যাওয়া করেছে।
ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান চৌধুরী বলেন, দু’দেশের ব্যবসায়ীদের
মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে– এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। ভারতে দর বেশি হওয়ায় সম্প্রতি চীন, মিসর, থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ পেঁয়াজ আমদানি করেছে। তবে বাণিজ্য নিরুৎসাহিত করতে সরকার পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
বেনাপোল দিয়ে আমদানি কমেছে সোয়া ৩ কোটি কেজি
আগস্ট মাসে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি কেজি আমদানি কম হয়েছে। জুলাই মাসে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি ৩৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৮ কেজি। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬৯ কেজি। এক মাসে আমদানি কমেছে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৫১ হাজার ৫০৮ কেজি। একইভাবে এ বন্দর দিয়ে রপ্তানিও কমেছে। জুলাই মাসে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৯২ হাজার ৩৯৩ কেজি। আগস্টে তা নেমে আসে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৮০০ কেজিতে। অর্থাৎ পণ্য রপ্তানি কম হয়েছে ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯৪ কেজি।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের যুগ্ম কমিশনার সাফায়েত হোসেন সমকালকে বলেন, জুলাই মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে আমদানি-রপ্তানি কিছুটা কম হয়েছে। জুলাই মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৪২৫ কোটি টাকা। আগস্ট মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪১০ কোটি টাকা।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) রাসেদুল সজীব জানান, গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেনাপোল বন্দর এলাকার পরিবেশ কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। এ জন্য আমদানি-রপ্তানিও কম হয়েছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রয়েল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, আগে প্রচুর ফল আমদানি হতো; কিন্তু মৌসুম এখন শেষ, তাই ফল আমদানি কম হচ্ছে। আগামী মাস থেকে আবার ফল আমদানি বৃদ্ধি পাবে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুজিবর রহমান বলেন, বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি আগের তুলনায় কিছুটা কম হচ্ছে। বন্দরে জায়গা সংকটের কারণে ভারতীয় ট্রাক দ্রুত খালাস করা সম্ভব হয় না।
অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কামাল উদ্দিন শিমুল বলেন, সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য অনেক আমদানিকারক পণ্য আমদানি কম করছেন এবং বন্দর থেকে পণ্য খালাসও নিচ্ছেন কম। ডলার সংকটের কারণে এলসি কম হচ্ছে। এসব কারণে আমদানি কমে গেছে।
ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা শঙ্কায়
জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি কম হয়েছে ৬৮১ টন। জুলাই মাসে ৩ হাজার ২০৯ টন পণ্য রপ্তানি হয়। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫২৮ টনে। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচলে তাজা মাছ, শুঁটকি মাছ, বর্জ্য তুলা, সিমেন্ট, পাথর, মেলামাইন সামগ্রী, পিভিসি পাইপ, পিভিসি ডোর ইত্যাদি রপ্তানি হয়ে থাকে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী রাজীব ভূঁইয়া বলেন, আখাউড়ায় আকস্মিক বন্যা ও দেশের অস্থিতিশীলতার কারণে আগস্ট মাসে এ বন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় পণ্য রপ্তানি কম হয়েছে। আগামী মাস থেকে পণ্য বাড়তে পারে।
তিনি জানান, বর্তমানে এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০ গাড়ি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ভারতে। স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, দেশের অস্থিতিশীলতা পরিবেশ ও বন্যার কারণে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি কমে গেছে। তবে সামনে ব্যবসার মৌসুম আসতেছে। আশা করা যায়, ব্যবসার গতি আগের জায়গায় ফিরে যাবে।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাবিবুল হাসান বলেন, আগের তুলনায় এখন ভারতের ত্রিপুরায় পণ্য রপ্তানি কম হচ্ছে। ডলারের রেটের তারতম্য, দেশের রাস্তাঘাট ও অস্থিরতার এবং ত্রিপুরার চাহিদা কম থাকার কারণে এ বন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানি কমে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে ত্রিপুরায়। আমাদের দেশে অস্থিরতা কারণে ওপারের ব্যবসায়ীরা পণ্য অর্ডার করতে ভয় পাচ্ছেন। পণ্যের অর্ডার করলে সময়মতো মাল দিতে পারব কিনা, তা জানতে চাচ্ছেন।
হিলি স্থলবন্দরে আমদানি অর্ধেক
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির পরিমাণ অর্ধেকে নেমেছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ৮০-৯০ ট্রাক পণ্য আমদানি হতো, এখন সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০টিতে। এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে কৃষিপণ্য, মসলাজাতীয় পণ্য ও পাথর আমদানি হয়ে থাকে। আমদানীকৃত এসব পণ্যের মধ্যে সিংহভাগ আমদানি হয় পেঁয়াজ। ইদানীং দেশে কাঁচা মরিচের সংকট থাকায় সেই জায়গা করে নিয়েছে এই পণ্যটি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অভ্যন্তরীণ সংকটের অজুহাতে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ভারতীয় ব্যবাসায়ীরা। এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংকগুলো শতভাগ মার্জিন ছাড়া এলসি খুলছে না। এতে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মূলধনের অভাবে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না।
সোনামসজিদ বন্দরেও অর্ধেক
সোনামসজিদ জিরো পয়েন্টে আগে ভারতীয় ট্রাকের দীর্ঘ সারি থাকলেও এখন সর্বোচ্চ থাকে ৫ থেকে ৬টি। বন্দরের ভেতরে বাংলা ও ভারতীয় শত শত ট্রাকে পণ্য খালাসের অপেক্ষায় থাকত। এখন প্রায় ফাঁকা।
এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করত। এখন আসছে ১৫০টির মতো ট্রাক। বন্দরে অব্যবস্থাপনার কারণেও আমদানি-রপ্তানি কমছে ভারতে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ইসমাইল হোসেন জানান, মূলত ডলার সংকটের কারণে ব্যবসা কিছুটা কমে গেছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক টানু জানান, এমনিতেই ডলার সংকট, তার ওপরে গত মাসে পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগপন্থি ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে। এতে করে এ বন্দরের ব্যবসা কমে গেছে।
(তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বেনাপোল, আখাউড়া ও হাকিমপুর প্রতিনিধি)