বিক্ষুব্ধ চা শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে, কবে পাবেন বেতন

ছয় সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছেন না রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির অধীন ১৬টি বাগানের শ্রমিক। বেতন না পেয়ে তারা কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন।

প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিকের সাপ্তাহিক বেতন দিতে না পারার জন্য সরকার পতনের পর পরিচালনা পর্যদ ভেঙে যাওয়া, চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হওয়ায় ঋণ না পাওয়া এবং চায়ের দাম না বাড়াকে কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে ন্যাশনাল টি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জে ন্যাশনাল টি কোম্পানির ১৬টি চা বাগান রয়েছে। এতে প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ১৭ হাজার শ্রমিক তাদের পরিবারের আরও প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে ভরণপোষণ করেন। বার বার বৈঠক করেও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো আশা পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। ফলে ক্রমেই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। এ কারণেই তারা সোমবার থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন।

শ্রমিকদের বেতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল টি কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এমদাদুল হক বলেন, শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না।

“২৮ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হওয়ার কথা। আপাতত ওই বৈঠক পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে।”

এদিকে চা শ্রমিক ও বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন চা পাতা তোলার মৌসুম। অনির্দিষ্টকালের এ কর্মবিরতিতে তিন দিনে প্রায় চার লাখ কেজি কাঁচা চা রয়ে গেছে সেকশনে। দু-একদিনের মধ্যে তা না উঠালে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

ন্যাশনাল টি কোম্পানির অধীন কুরমা চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি নারদ পাশি বলেন, “প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। বাগানের শ্রমিকদের অতিরিক্ত কোনো আয় নেই।

দৈনিক হাজরি (বেতন) দিয়েই চলতে হয়। তারা এক-দুই সপ্তাহ বাকিতে বাজার করে চলছেন। এখন কেউ বাকিও দিচ্ছে না। প্রত্যেক পরিবারেই শিশু সন্তান রয়েছে। না খেয়ে কয়দিন থাকা যায়? নিরুপায় হয়ে তারা এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।”

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি বলেন, “ছয় সাপ্তাহ ধরে তাদের মজুরি বন্ধ রয়েছে। মজুরি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

“বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে হাজরি দেবে। কবে ঋণ পাবে আর কবে হাজরি দেবে। এ অবস্থায় শ্রমিকরা কিভাবে চলবে? বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার।”

কমলগঞ্জ মাধবপুরের পদ্মছড়া চা-বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি কৃষ্ণলাল দেশোয়ারা বলেন, “আমাদের শ্রমিকদের ঘরে খাবার নেই, চা বাগানের কাজ অনেক পরিশ্রমের। পেটে ক্ষুধা নিয়ে শ্রমিকরা কীভাবে মাঠে কাজ করবে? মালিকপক্ষ বকেয়া মজুরি পরিশোধ না করলে তারা কাজে ফিরবেন না।”

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, “মজুরি পরিশোধের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ তা বাস্তবায়ন করেনি। তাই চা শ্রমিকদের এ কর্মবিরতিতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সমর্থন আছে।”

সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ন্যাশনাল টি কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক এমদাদুল হক বলেন, প্রতিবছর এই সময়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক তাদের এডিশনাল একটি ঋণ দেয়। সরকার পরিবর্তন হওয়ায় তাদের পরিচালনা পরিষদের তিনজন সদস্য বাতিল হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানও নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় কৃষি ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে না।

“চলতি মৌসুমে কৃষি ব্যাংক থেকে ৮৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এটি পরিশোধ করা হচ্ছে। এদিকে উৎপাদিত চায়ের উৎপাদন ব্যয় হয় প্রতি কেজিতে ২০০ টাকার উপরে। আর বিক্রি হচ্ছে গড়ে ১৮০ টাকা ৮৩ পয়সা। তাও আবার সব চা বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সংকট কাঠাতে কৃষি ব্যাংকের কাছে আরো ৪৪ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়েছে।”

জিএম বলেন, “কিন্তু তাদের পরিচালনা পর্ষদ পূর্ণাঙ্গ পুনর্গঠন না হওয়ার কারণে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সমস্যা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পরিষদর গঠন হলে তারা দ্রুত ঋণ পাবেন এবং শ্রমিকদের মজুরিও পরিশোধ করতে পারবেন।”

ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চারজন প্রতিনিধি, শেয়ার হোল্ডার থেকে তিনজন, রাজনৈতিকভাবে সতন্ত্র তিনজন ও এমডি মিলিয়ে ১১ জনের বোর্ড। এই বোর্ড একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে।

বর্তমানে সরকার পরিবর্তনের কারণে রাজনৈতিকভাবে প্রাপ্ত সতন্ত্র তিনজন পরিচালক নেই। ফলে বড় সিদ্ধান্ত ও ব্যাংক ঋণ নেওয়া যাচ্ছে না।

এর বাইরেও কোম্পানির শেয়ারের আরো ২৮৯ কোটি টাকা তাদের ফান্ডে আছে। কিন্তু দুইজন শেয়ার হোল্ডার হাই কোর্টে রিট করায় সেই টাকাও তারা খরচ করতে পারছেন না বলে জানান জিএম এমদাদুল হক।

চা বাগানগুলোতে এখন উৎপাদনের সময় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন ন্যাশলাল টি কোম্পানির বাগানগুলো থেকে গড়ে প্রায় ১২ হাজার কেজি কাঁচা চা উত্তোলন করা হয়। ১২টি বাগানে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার কেজি চা উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এতে বিগত তিন দিনে প্রায় সাড়ে চার লাখ কেজি চা উত্তোলন হয়নি। পাতা বড় হচ্ছে, দু-একদিনের মধ্যে তা না উঠালে পুরোটাই নষ্ট হবে।

এস/ভি নিউজ

পূর্বের খবর৫ বছর পর মোদি-শি বৈঠক, কী বার্তা এলো
পরবর্তি খবরসিন্ডিকেট ভাঙতে কৃষিবাজার তৈরি করবে সরকার: শ্রম উপদেষ্টা