বিশেষ প্রতিনিধি: বাংলা গানের কালজয়ী একটি নাম ফেরদৌসী রহমান। ভিন্নময়তা গানের ফিল্ম বলতে একনামে আলাদা করা যায় ফেরদৌসী রহমানকে। যেন শিল্প হয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন এই গুণী মানুষটি। দেশের বাংলা গানের একটি বিরাট জায়গা জুড়ে আছে তাঁর অবস্থান। দেশের, সমাজের জন্যও আছে মহান এই মানুষটির ভাবনা, শিশুরাই হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। তাই সাথে সাথে যখন কোনো মানুষ সাংস্কৃতিক স্পর্শে বেড়ে ওঠে তখন একটি মানুষ হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ।
ছোটদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠান তিনিই বাংলাদেশে প্রথম শুরু করেন। মাত্র ১১ জন বাচ্চাকে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছোটদের গানের অনুষ্ঠান ‘গানের আসর’ তিনি গান শেখানোর দায়িত্ব নিজ হাতে নেন।
গায়িকা, সংগীত পরিচালিকা। ১৯৪১ সালের ২৮ জুন পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে জন্ম হয়েছিল এই তারকার। এমএ (সমাজ বিজ্ঞান)।
বাবা প্রখ্যাত পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ । তাঁর দুই ভাই। এক ভাই সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। অন্য ভাই বিচারপতি মুস্তফা কামাল ।
১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন রেজাউর রহমানকে। তিনি একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।বিয়ের পরই ফেরদৌসী বেগম থেকে তিনি হলেন ফেরদৌসী রহমান। তাঁর ২টি ছেলে রুবাইয়াত ও রাজিন।
ফেরদৌসী রহমান পল্লীগীতি ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান ও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকসহ সব ধরনের গানই করেছেন। বাংলা ছাড়া তিনি উর্দু, ফারসি, আরবি, চীনা, জাপানি, রুশ, জার্মানসহ আরও বেশ কিছু ভাষায় গান গেয়েছেন। সংগীত পরিচালনাও করেছেন।প্রথম কোনো মহিলা সংগীত পরিচালক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ১৯৬১ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির মাধ্যমে। ওই ছবিতে ফেরদৌসী বেগমের সঙ্গে রবীন ঘোষও সুরকার হিসেবে ছিলেন। স্বাধীনতার পর ফেরদৌসী বেগম ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গাড়িয়াল ভাই’ ও ‘নোলক’ ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন।
বিটিভিতে বাচ্চাদের হাতেকলমে গান শেখার আসর ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান শুরু তার হাত দিয়েই। যে অনুষ্ঠানটি সারা বাংলাদেশে তুমুল গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়।পাপেট মিঠু-মন্টি, গানের খালামণি-কত কি-ই না এই একটি অনুষ্ঠান থেকে পেয়েছে দর্শকরা! অন্যদিকে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে সাংস্কৃতিক টিম দেশের বাইরে যায়, তার নেতৃত্বও দেন তিনি।
ফেরদৌসী রহমানের প্লেব্যাক করা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৫০-এর কাছাকাছি। ৩টি লং প্লেসহ প্রায় ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড এবং দেড় ডজনের বেশি গানের ক্যাসেট বের হয়েছে তাঁর। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার গানের রেকর্ড হয়েছে তাঁর। তিনি ১৯৫৯ সালে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব গান করেছেন তার সব আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। এ প্রজন্মের শিল্পীরাও তার গাওয়া সেদিনের গান আজও নতুন করে গাইছেন।
দেশের অনেক সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। আবদুল আহাদের সুরে আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি তিনিই গেয়েছেন।
ফেরদৌসী রহমানের গান বাংলা ছবিতে জনপ্রিয়তা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল।১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফেরদৌসী ছাড়া সিনেমার গান ছিল প্রায় অচল । ঢাকার সিনেমা হিট হওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফেরদৌসীর গান। ‘মনে যে লাগে এতো রঙ ও রঙিলা’, ‘নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি’, ‘এই সুন্দর পৃথিবীতে আমি এসেছিনু নিতে’, ‘এই রাত বলে ওগো তুমি আমার’, ‘বিধি বইসা বুঝি নিরালে’, ‘এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ’, ‘মনে হলো যেন এই নিশি লগনে’, ‘ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা’, ‘আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘পদ্মার ঢেউরে’, এমনি শত শত গান সিনেমায় আর রেকর্ডে গাওয়ার কারণে এক সময়ে তার জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেছিল গগনচুম্বী।
ফেরদৌসী রহমান নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। আমাদের সঙ্গীত ভুবনে অবদান রাখার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন। তাঁর অর্জিত উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে আছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩ সাল), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫ সাল),টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক (১৯৭৭),বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬),নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুল্লাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার, একুশে পদক (১৯৭৭ সাল)।
ফেরদৌসী রহমান বেশ কিছুদিন হলো নিজের আত্মজীবনী লিখছেন। তবে গেলো দু’বছর ধরে তিনি নিয়মিতই তার আত্মজীবনী লেখা নিয়ে ব্যস্ত। এই সময়ের সংগীতশিল্পীদের গায়কী প্রসঙ্গে ফেরদৌসী রহমান বলেন, ‘এখন যারা গান করছেন তাদের মধ্যে অধ্যবসায়টা খুবই কম। মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খন্দকার ফারুক আহমেদের মতো বরেণ্য শিল্পীরা চাকরি করার পাশাপাশি গান করেছেন। তারা গানে অধ্যবসায়ী ছিলেন। আর এখন যারা গান করছেন তারা তো শুধুই গান করছেন। যদি তাই হয় তাহলে সাধনা কেন করবে না? আমার কথায় রাগ হলেও আমি বলব সংগীত এমন একটি বিষয়- যে যত বেশি সাধনা করবে সে তত বেশি স্থায়ী হতে পারবে।’
বর্ণিল জীবনের ৭৮টি বসন্ত পেরিয়ে ৭৯-তে পা দিচ্ছেন গুনী শিল্পী ফেরদৌসী রহমান ।বাংলা সংগীতাঙ্গনের সবার প্রিয় এই মানুষটি দীর্ঘ দিন ধরেই মিডিয়ার বাইরে। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে বাসাতেই এখন সময় কাটে তার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দাওয়াত এলেও যেতে পারেন না। তবে জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে যান না স্বজন ও সংগীতের মানুষেরা। জন্মদিন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যরা উইশ করে। এছাড়া কাছের আত্মীয়স্বজন ও গানের মানুষেরা খোঁজ নেন। অনেকের সঙ্গে কথা হয়। এজন্য ভালো লাগে। সবার কাছে দোয়া চাই।’
ফেরদৌসী রহমান বলেন, ‘আমরা যারা বলা যায় একসঙ্গে কাজ শুরু করেছিলাম তাদের অনেকেই আজ নেই। সে কারণে মন খারাপই থাকে। আবার করোনার কারণে দীর্ঘদিন যাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি সেইসব প্রিয়মুখও চলে গেলেন। শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যার, শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, মোস্তফা কামাল সৈয়দসহ আরও বেশকিছু প্রিয় মানুষ আমরা হারিয়েছি। এতো এতো চেনা মানুষ বিগত মাত্র কয়েকটি দিনে আমরা হারিয়েছি যে মনটা সত্যিই ভেঙে গেছে। এই ভাঙা মন নিয়ে আসলে নিজের কথা কেমন করে ভাবব? ভাবা যায় না, আমি ভাবতে পারি না। দেশের সার্বিক যে পরিস্থিতি তাতে আমার জন্মদিন কারও কাছেই তেমন গুরুত্ব বহন করে না। আমি চাই আল্লাহ যেন সবাইকে সুস্থ রাখেন, ভালো রাখেন। আবার যেন সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করতে পারি, সবার মুখে যেন হাসি দেখতে পারি। অন্যের হাসির মাঝেই নিজের সুখ না হয় খুঁজে নিব।’
পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের মেয়ে। প্রথম ‘আসিয়া’ ছবিতে কণ্ঠ দেন। ১৯৬০ সালে তিনি ‘রাজধানীর বুকে’ ছবির সংগীত পরিচালনা করেন রবীন ঘোষের সঙ্গে। এককভাবে সংগীত পরিচালিত ছবি মেঘের অনেক রং ও নোলক। কণ্ঠ দেন এ দেশ তোমার আমার, হামসফর, রাজধানীর বুকে, আযান (উত্তরণ), তোমার আমার, সূর্য স্নান, জোয়ার এলো, নতুন সুর, হারানো দিন, চান্দা, তালাশ, এইতো জীবন, সংগম, পয়সে, কারওয়ী, শাদী বন্ধন, প্রীতনা জানে রীত, সুতরাং, সাতরং, আয়না ও অবশিষ্ট, কাজল, মিলন, গোধূলির প্রেম, গুনাই বিবি, জানাজানি, কাগজের নৌকা, বেগানা, হীরামন, চাওয়া-পাওয়া, ম্যায়ভি ইনসান হু, বিনিময়, নয়নমণি, নোলক, ঈমান প্রভৃতি। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছে।