প্রণয় ভার্মা
একটি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, যাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের প্রতি আমরা দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করি, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধন শক্তি লাভ করে এই বিশ্বাস থেকে যে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। এবং তাই আমরা বহুমুখী সহযোগিতার একটি দৃঢ় কাঠামোর মাধ্যমে পারস্পরিক সমৃদ্ধিতে অভিন্ন অংশীদারি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাই।
ভৌগোলিক অবস্থান, উদীয়মান সক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক আর বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বাংলাদেশ কেবল আমাদের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির একটি স্তম্ভই নয়, বরং এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর সংযোগস্থলে অবস্থান করছে; যেমন—‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’, সাগর মতবাদ (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ ফর অল ইন রিজিয়ন) এবং আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক দর্শন।
আমাদের বিশ্বাস, এটি শুধু আমাদের দুই দেশের জন্য নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্যও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে অনেক রূপান্তরমূলক পরিবর্তন ঘটেছে এবং যা এই অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছে, সেগুলো একে অপরের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমরা যে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা দেখিয়েছি তার ফল। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ও ভারতকে লক্ষ্যবস্তুকারী বিদ্রোহীদের আশ্রয় না দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প আমাদের সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের অন্যতম বড় সাফল্য—আমাদের সমুদ্র ও স্থল সীমানার সমাধান, যা আমাদের স্থল ও সমুদ্র সংযোগের পাশাপাশি সুনীল অর্থনীতিতে (ব্লু-ইকোনমি) সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ উন্মুক্ত করেছে। পার্মানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে বিষয়টি উপস্থাপন করে আমাদের সমুদ্রসীমা সমাধান এবং তার পরে সেটির রায় মেনে চলাটা হলো গণতান্ত্রিক ও নীতিনির্ধারিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি আমরা যে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তা আমাদের দ্বিপক্ষীয় আচরণে প্রতিফলিত হওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ।
আমাদের বহুমুখী অংশীদারির রূপান্তরের একটি মূল প্রকাশ, যা আমাদের উভয় দেশের জনগণকে সরাসরি উপকৃত করেছে, তা হলো আমাদের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং আমাদের সংযোগ লিংকগুলো।
আজ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ও বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম অংশীদার। সাফটার আওতায় ভারত একপক্ষীয়ভাবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে সব ধরনের পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকে ভারতে বৃহত্তর রপ্তানি সক্ষম করেছে।
আমরা প্রায়ই বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সম্পর্কে উদ্বেগ শুনে থাকি, তবে এটি উপলব্ধি করাটা গুরুত্বপূর্ণ যে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে রপ্তানির বেশির ভাগই বাংলাদেশের রপ্তানির একটি বড় অংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ হিসেবে কাজ করে, যা বাংলাদেশকে মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবেলায় সাহায্য করে।
প্রকৃতপক্ষে একটি কম প্রশংসিত বাস্তবতা হলো ভারত এখন সমগ্র এশিয়ায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজারগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে গত কয়েক বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি সর্বদা দুই বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই রয়েছে। এবং আমরা চাই এই সংখ্যাটি বৃদ্ধি পাক।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সংযোগ একেকটি প্রধান সহায়ক, যা আমাদের সমাজ, আমাদের ব্যবসায় ও আমাদের জনগণকে একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হতে ও পরস্পরের মাধ্যমে উপকৃত হতে সহায়তা করে। এবং আমরা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছি।
একটি সন্নিহিত ভৌগোলিক অবস্থান ও দীর্ঘ অভিন্ন ইতিহাস নিয়ে, বিভিন্ন উপায়ে, আমরা আসলে আমাদের দুটি দেশকে পুনরায় সংযুক্ত করার চেষ্টা করছি। আমরা যাত্রী ও পণ্য উভয়ের জন্য ১৯৬৫-এর আগের সাতটি রেলপথের মধ্যে ছয়টি পুনরুদ্ধার করেছি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগের একটি বড় অংশ ৩৬টি কার্যকর স্থল শুল্ক বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যার মধ্যে পাঁচটিকে সমন্বিত চেকপোস্টের স্তরে উন্নীত করা হয়েছে। এই মাসের ঠিক শুরুতে আমরা পেট্রাপোল সমন্বিত চেকপোস্টে নতুন অবকাঠামো সংযোজন করেছি, যা পণ্য পরিবহন ও যাত্রী সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে।
আজ বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা তিনটি বড় ভারতীয় বিমানবন্দর—কলকাতা, দিল্লি ও বেঙ্গালুরুকে তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য অত্যন্ত সাশ্রয়ী ট্রান্সশিপমেন্ট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, যা পশ্চিমা বাজারে বাংলাদেশের পণ্যগুলোকে আরো প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে। আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দরগুলো বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের একই ধরনের সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
আমাদের সংযোগগুলো শুধু বাণিজ্য ও পরিবহনেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা শক্তিশালী জ্বালানি সংযোগও নির্মাণ করছি। এর কিছু উদাহরণ হলো—গত বছর চালু হওয়া একটি নতুন আন্ত সীমান্ত ডিজেল পাইপলাইন, যা ভারতের একটি শোধনাগার থেকে বাংলাদেশে হাইস্পিড ডিজেল নিয়ে আসে; আন্ত সীমান্ত বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনগুলো, যা ভারতের পাওয়ার গ্রিড থেকে বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে এবং মাত্র দুই দিন আগে ভারতের গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ। আমাদের জ্বালানি সংযোগ ও সহযোগিতা কিভাবে আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করছে এবং একটি সত্যিকারের আঞ্চলিক অর্থনীতি গঠনে অবদান রাখছে, এই সব উদাহরণ তা প্রদর্শন করে।
সংক্ষেপে সংযোগের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সহজ একটি বিষয়—আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্যকে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করা, যা আমাদের দুই দেশের মানুষ ও পুরো অঞ্চলের জন্য উপকার বয়ে আনে।
জনগণই আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি—এই বিশ্বাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন কভিড-১৯ আমাদের আঘাত হানে এবং আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে উদারভাবে এগিয়ে আসি। এটি বাংলাদেশের জন্য আমাদের বিস্তৃত ভিসা কার্যক্রমেও প্রতিফলিত হয়, তবে বর্তমানে সীমিত কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রতিদিন ঢাকার অন্য যেকোনো কূটনৈতিক মিশনের তুলনায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বেশি ভিসা ইস্যু করে থাকি।
আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রক্ষক হিসেবে যুবসমাজ আমাদের অংশীদারির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। সুধীসমাজ, গণমাধ্যমসহ সব অঞ্চল ও শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশি যুব ও তরুণ পেশাজীবীদের প্রতিবছর ভারত প্রদত্ত বৃত্তির মাধ্যমে এটিই সুস্পষ্ট হয়। মাত্র দুই মাস আগে, ভারতের আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে আমাদের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঁচ শতাধিক অত্যন্ত মেধাবী বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রী রওনা দেয়। আমাদের বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন বা জনপ্রিয়ভাবে পরিচিত বিওয়াইডি কর্মসূচি, আমাদের ইয়ুথ আউটরিচের জন্য আরেকটি শক্তিশালী প্ল্যাটফরম, দেশব্যাপী যার আজ একটি গর্বিত অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক রয়েছে।
সব মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি স্থিতিশীল, ইতিবাচক এবং গঠনমূলক সম্পর্কের চেষ্টা চালিয়ে যাবে, যেখানে আমাদের জনগণ হবে প্রধান অংশীজন। আমরা অতীতে যেমন সমর্থন করেছি, তেমনি ভবিষ্যতেও একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অগ্রসর বাংলাদেশকে সমর্থন করে যাব।
আমরা শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য আমাদের জনগণের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা পূরণে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের অংশীদারি উভয় দেশের সাধারণ মানুষের জন্য উপকার বয়ে আনবে।
ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই আজ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত ও সক্ষম। একই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতি ও উন্নয়নের পথ একে অপরের সঙ্গে আরো জড়িয়ে যাওয়ার ফলে আমরা আজ একে অপরের ওপর আগের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরশীল। আমাদের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে ক্রমাগত শক্তিশালী করতে হবে।
ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতাসহ দুটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী সমাজ হিসেবে আমরা একে অপরকে অনেক কিছু দিতে পারি এবং যদি আমরা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে, বাস্তবসম্মত ও গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকতে পারি, তবে নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারব। আমাদের বিশ্বাস, একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ভারতের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ভারত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এবং একটি চূড়ান্ত প্রতিফলন—বাংলাদেশের বিক্ষোভপূর্ণ পরিবর্তন সত্ত্বেও আমাদের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক, পরিবহন ও জ্বালানি সংযোগ এবং জনগণের মধ্যে সম্পৃক্ততা যে ইতিবাচক গতি বজায় রেখেছে, তা প্রমাণ করে যে আমাদের সম্পর্ক সত্যি বহুমুখী এবং একক কোনো এজেন্ডা বা ইস্যুতে সেটি সীমাবদ্ধ নয়। কিছু বিরক্তিকর বিষয় রয়েছে, কিন্তু সেগুলো আমাদের সম্পর্কের সামগ্রিক অগ্রগতিকে সীমাবদ্ধ করতে পারেনি। দুটি জাতি হিসেবে, যাদের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি আমাদের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক শিকড়ের মতোই পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, আমাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও পারস্পরিক সুবিধার বাস্তবতা রাজনৈতিক হাওয়ায় পরিবর্তনের পরও বারবার নিজেকে পুনর্ব্যক্ত করতে থাকবে।
আমাদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গতিপথ ও আখ্যানকে আকার প্রদান করতে হবে, বস্তুনিষ্ঠতা আর সহানুভূতির সঙ্গে।
লেখক : ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার
* এই নিবন্ধটি ঢাকায় সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ কর্তৃক আয়োজিত বে অব বেঙ্গল কনভার্সেশনস ২০২৪ (বঙ্গোপসাগর সংলাপ ২০২৪)-এ হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার সাম্প্রতিক বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ
এস/ভি নিউজ