ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ইডেন কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্নের পর ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়টির রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ হাসিনা।
গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশির ভাগ মন্ত্রীই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। শেখ হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী কাঠামো তৈরি ও তা দৃঢ় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা রাজনীতিবিদ-আমলা ও বিচারকদেরও বড় একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের কেউ কেউ এখানে শিক্ষকতাও করেছেন। এছাড়া ব্যবসায়ী অলিগার্কদেরও বড় অংশই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
দলটির শাসনামলে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দলীয়করণ এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন প্রয়াত হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম)। তার তত্ত্বাবধানে কোনো রাখঢাক ছাড়াই প্রশাসনের ব্যাপক দলীয়করণ ঘটে। সেই দলীয়করণকৃত প্রশাসনকে নির্বাচনে জয়লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করা এইচটি ইমাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান প্রয়াত আবুল মাল আব্দুল মুহিত। টানা ১০ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আবুল মাল আব্দুল মুহিতও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও পরের বছর একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বানোয়াট পরিসংখ্যান তৈরির বড় কারিকর ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)। ২০১৪ সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন তিনি। লোটাস কামাল মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের পরিসংখ্যান বিভ্রাট প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডাটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে একটি সিন্ডিকেট। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও বাড়তে থাকে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য। এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পরবর্তী মেয়াদগুলোয়ও। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই কেবল সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল। ২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতায় এলে মিথ্যা তথ্য তৈরির পুরস্কার হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে বসান শেখ হাসিনা। এরপর দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের পরিস্থিতি আরো বেশি নাজুক হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে কমার্সে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থাকে আইনি সুরক্ষা দিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ২০১৪ সাল থেকে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। আনিসুল হকও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। বিভাগটি থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
আনিসুল হকের মতোই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মেয়াদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিরোধী দল ও বিরুদ্ধ মত দমনে যিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে দলীয় কর্মীর মতোই ব্যবহার করেছেন। তিনিও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।
২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা এক দশক শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। দেশে শিক্ষা খাতের বর্তমান দৈন্যদশার পেছনে অন্যতম দায়ী মনে করা হয় তাকে। নুরুল ইসলাম নাহিদের মেয়াদকালে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আওয়ামী লীগের শাসনামলের প্রায় পুরো সময়েই নানা কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছে দলটির ‘ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন’ ছাত্রলীগ। এ দেড় দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সব সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকেই বেছে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
দেশের অর্থনীতি ও আর্থিক খাত এখন মারাত্মক নাজুক অবস্থায় পড়েছে। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ঘটেছে নজিরবিহীন সব লুণ্ঠন ও কেলেঙ্কারির ঘটনা। কারসাজির মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে বের করে নেয়া হয়েছে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) ব্যবহৃত হয়েছে দুর্নীতিবাজদের হাতিয়ার হিসেবে। দেশের আর্থিক খাতের এ দুরবস্থার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে দায়ী করা হয়।
২০০৯ সালের ১ মে থেকে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. আতিউর রহমান। তার সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠন, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো একের পর এক বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর গভর্নর পদ থেকে তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। ড. আতিউর রহমান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবেও যোগ দেন।
দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এক যুগেরও বেশি সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক। তারা হলেন ফাইন্যান্স বিভাগের ড. এম খায়রুল হোসেন এবং ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। অভিযোগ আছে, চেয়ারম্যান হিসেবে এ দুই অধ্যাপকের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও স্বজনপ্রীতির কারণে পুঁজিবাজার আরো খাদের কিনারে এসে পৌঁছায়। জাল-জালিয়াতি, কারসাজি, প্লেসমেন্ট শেয়ার ও প্রতারণার মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে গত ১৫ বছরে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি লুণ্ঠিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দুই সাবেক শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে গত দেড় দশকে নানা মাত্রার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল, ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ না করেই শতাধিক শিক্ষককে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বেশ কয়েকটি বিভাগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে এবং পদের অতিরিক্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এছাড়া এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব পেলেও তার মেয়াদকালে মেধা তালিকায় থাকা শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের পদধারীদের নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে।
আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থীরাও। ২০২৩ সালে সরকারের নতুন শিক্ষা নীতির আওতায় বিভিন্ন শ্রেণীর বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইসহ একাধিক নতুন পাঠ্যবইয়ের সহ-লেখক এবং প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তবে বিজ্ঞান পাঠ্যবইটি প্রকাশের পর এতে বিদেশী ব্লগ থেকে কপি-পেস্ট ও যান্ত্রিক অনুবাদের অভিযোগ ওঠে। পরে জাফর ইকবাল বইটির জন্য তার ভুলের কথা স্বীকার করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরের বছর ১৯৭৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তবে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে স্লোগান বিতর্ককে কেন্দ্র করে বাকি জীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। এতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন তাসনীম আরেফা সিদ্দিকী মনে করেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি নৈতিক জায়গা হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষক নিয়োগ সবসময় যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে সম্পূর্ণ দলীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ব্যবস্থাও একই। বিশুদ্ধ রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদগুলো যারা অলংকৃত করবেন; তারা যদি যোগ্যতার ভিত্তিতে আসেন, তাহলেই শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়ন করা সম্ভব। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় শিক্ষকদের সম্মান দেন না। কারণ তারা যে পজিশন হোল্ড করে, নিয়োগ ও পদায়নে যোগ্যতার কোনো মূল্য নেই। যোগাযোগটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ছাত্রজীবনে মানুষের লোভ কিংবা পিছুটান থাকে না। এ সময় আন্দোলন-সংগ্রামে সে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু কর্মজীবনে গিয়ে সেটি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এর কারণ হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি, করতে দেয়া হয়নি। যারাই ক্ষমতায় গেছে তারাই নিজেদের স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ায় রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরীর মতো অবিসংবাদিত ছাত্রনেতারা পরিণত বয়সে এসে নিজেদের নাম-খ্যাতি ব্যবহার করে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করেছে। তারা আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।’
২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী বিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সুযোগ করে দিয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি রায়। ফিরে আসে দলীয় সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণের প্রথা, যা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি রচনা করে। তুমুল সমালোচিত এ প্রধান বিচারপতিও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতক। খায়রুল হকের পর ২০১১ সালের ১৮ মে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পান মো. মোজাম্মেল হোসেন। ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিচার বিভাগের নেতৃত্ব দেয়া এ বিচারপতিও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।
আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত আমলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি এ পদে নিয়োগ পান। আওয়ামী লীগ সরকারকে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় নিয়ে আসতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী হিসেবে তিনি নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন। তিনিও ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক এবং পরবর্তী সময়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন।
দেশের ইতিহাসে প্রথম পলাতক গভর্নর ও সাবেক অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখান থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন তিনি। অর্থ ব্যবস্থার মৌলিক নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি নিরুদ্দেশ হন।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় থাকার পথ প্রশস্ত করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে গত তিন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে। এ তিন নির্বাচন কমিশনের প্রধান ছিলেন কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ, কেএম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাদের মধ্যে রকিব উদ্দিন আহমদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। আর কেএম নুরুল হুদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন। কাজী হাবিবুল আউয়াল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র। কর্মক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কার হিসেবে শেখ হাসিনা তাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
দেশের জ্বালানি খাতের বর্তমান দুরবস্থার প্রধান দুই কারিকর ধরা হয় সাবেক দুই আমলা মো. আবুল কালাম আজাদ ও আহমেদ কায়কাউসকে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক চাপ তৈরির জন্য বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে তাদের ভূমিকাকে অনেকাংশেই দায়ী করা হয়। এর মধ্যে আবুল কালাম আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।
আওয়ামী লীগ আমলে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে নানা চুক্তি ও এজেন্ডায় বিশেষ সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে এক প্রকার নতজানু পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ২০১০ সালে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর এ নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের কারিকর ছিলেন ২০১৩ সালে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যোগদান করা মো. শহীদুল হক। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। শহীদুল হকের পর মাসুদ বিন মোমেন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যোগদান করেন ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা এ কূটনীতিকও শেখ হাসিনার আস্থা অর্জনে যারপরনাই অনুগত ছিলেন। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের ব্যাপক প্রয়াস চালানো, সরকারের নির্বাচন পরিকল্পনায় প্রতিবেশী দেশটির আনুকূল্য প্রতিষ্ঠায় এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারের খেয়ালখুশিমতো উপস্থাপনের গুরুদায়িত্ব তিনিই পালন করেছেন।
দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে। আবার কর্মজীবনে গিয়ে অনেকেই প্রলোভন, পদোন্নতি আর ক্ষমতার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানের সব ছাত্রই গুণগত ও চারিত্রিক মানে উন্নীত হবে এটি প্রত্যাশা করা ঠিক নয়। একই প্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে কেউ আলেম হতে পারে, আবার কেউ জালেমও হতে পারে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা নীতিনিষ্ঠার ওপর অটল থাকতে পারলে দেশের চিত্র এ রকম হতো না। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও দেখা যাবে, এখানে সবাই একই উদ্দেশ্যে যায়নি। এখানে বহুমতের-বহুপথের সম্মিলন ঘটেছে। তবে আগামীর নতুন বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে তা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা কিছু ছাত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলে হবে না।’
শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদে রূপান্তরে দেশের ব্যবসায়ীদেরও বড় ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক হিসেবে বেড়ে ওঠা ব্যবসায়ীদের বড় অংশও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনৈতিকতার চর্চা, রীতিনীতি ধ্বংস ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোয় দখলদারত্বের সংস্কৃতি চর্চার জন্য দায়ী করা হয় সালমান ফজলুর রহমানকে (সালমান এফ রহমান)। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন।
দেশে বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় অলিগার্ক মনে করা হয় সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খানকে। দেশের বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। বাংলাদেশে ব্যবসা করে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের কাতারে স্থান করে নেয়া এ ব্যবসায়ীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। ১৯৮০ সালে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশকে দানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে বড় ভূমিকায় ছিল পুলিশ বাহিনী। ২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) পদে দায়িত্ব পালন করা পাঁচজনই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ সময়ে পুলিশ প্রধান হিসেবে ছিলেন নূর মোহাম্মদ, হাসান মাহমুদ খন্দকার, একেএম শহীদুল হক, মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ও বেনজীর আহমেদ। আইজিপি ছাড়াও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বড় অংশও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাপকমাত্রায় আলোচনায় আসা পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশিদও (ডিবি হারুন) এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের মধ্যে যখন নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন থাকে না, তখন সে অনায়াসে নিপীড়ন চালায়। নিপীড়নের জায়গা থেকে ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়। আমাদের গেস্টরুমসহ নানা জায়গায় যে নিপীড়নগুলো হয়েছে, সেখান থেকেই নিপীড়নের মনমানসিকতা তৈরি হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে কথা বলার পরিবেশ ও মনমানসিকতা না থাকায় রাষ্ট্রীয় জায়গাগুলোয় এ চর্চার প্রতিফলন দেখা যায়। একজন শিক্ষার্থী কারিকুলামে যা পায়, তার চেয়ে আশপাশের পরিবেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্জন করে। একজন শিক্ষার্থীকে যখন অন্য একটি শিক্ষার্থী মেরে ফেলে, তখন তো আর সেই নৈতিকতা থাকে না। প্রত্যেকটি জায়গায় আমাদের নৈতিকতা আনা উচিত বলে মনে করি। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধকে জাগ্রত করা উচিত বলে মনে করি।’
এস/ভি নিউজ