বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগৎ শোকাভিভূত করে চিরবিদায় নিলেন আনিসুজ্জামান এবং দেবেশ রায়। একই দিনে দুই নক্ষত্রপতন যেমন অভাবনীয় বিপর্যয়, তেমনই দুর্বহ তার আঘাত। একের প্রয়াণসংবাদ যে শোক ও আচ্ছন্নতায় অগণিত ভাষাপ্রেমীকে দ্রব করেছে, তারই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকজনের চিরবিদায় নিষ্ঠুর নিয়তির ভয়ঙ্কর উৎপাত বলে মনে হয়।
আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়— দু’জনেই বাংলা সাহিত্যজগতে দুই দিকপাল। দু’জনেই সৃজনশীল ও প্রাজ্ঞ। বাংলার ভাষার তরণিতে এই দুই শক্তিমান কান্ডারি রাজনৈতিক সীমানা অতিক্রম করে দুই বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্যে অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের চিরবিদায় যে শূন্য আসন রেখে গেল, তার আর প্রতিপূরণ হতে পারবে না।
আনিসুজ্জামানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় তাঁর ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থপাঠে। মননশীল বিশ্লেষণ ও সবিস্তার আলোচনা সম্বল করে রচিত এই অক্ষয় প্রবন্ধগ্রন্থপাঠ কতজনের বোধ, ধারণা, জ্ঞান, বাংলা সাহিত্য বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে, কত জনের সাহিত্যবোধের কূপমণ্ডুকতা বিদূরিত করেছে, তার সংখ্যা নির্ণয় করা অসম্ভব। তাঁর এই গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এক নবদিশার আনয়ন। শুধু তাই নয়, দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আনিসুজ্জামান তাঁর প্রজ্ঞা ও পরিশীলিত দৃষ্টিপাতে ১৭৫৭ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্যের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশেষত্ব লিপিবদ্ধ করলেন, তা সাহিত্যমাধ্যমে এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইল।
বহু গুণ ও অপার জ্ঞান তাঁকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জগতে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। সেই সঙ্গে, যারা তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে জানার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরাও তাঁকে চিরায়ুষ্মান করে রাখবেন।
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমাজ বিশ্লেষক দেবেশ রায় বর্তমানের অনেক লেখকের কাছেই আক্ষরিক অর্থে অভিভাবকের আসনে সমাসীন। সেই অভিভাবকত্ব সাহিত্যবোধ উন্নীতকরণের, ভাষাবোধ বিস্তারের। সেই অভিভাবকত্ব এক প্রজ্ঞাবানের পায়ের কাছে বসে প্রশ্ন করার অধিকার প্রদান, দেবেশ রায় যা দিয়েছেন অনেককেই।
ভাষাশিল্পী দেবেশ রায় উত্তরবাংলার মানুষ। তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকীর্তির বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিত উত্তরবঙ্গ। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ তাঁর সুপরিচিত উপন্যাস। হয়তো যিনি সাহিত্যপিপাসু নন, কিন্তু সংস্কৃতির অন্য আরও ক্ষেত্রে বিচরণ করেন, তিনিও এই গ্রন্থের নাম জেনে থাকবেন। কিন্তু ‘তিস্তা পুরাণ’ ও অন্যান্য উপন্যাস বা গল্পগুলি না পড়লে দেবেশ রায়ের সাহিত্যক্ষমতা সম্পূর্ণ আস্বাদন করা যাবে না। সাহিত্য রচনাকালে এক আশ্চর্য ভাষা সম্ভার ও গভীর বিশ্লেষণী মেধা নিয়ে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন বারংবার। কলকাতায় বাস করলেও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে তাঁর সংযোগ নিবিড়তা কখনও ক্ষীণ হয়নি। তাঁর চিন্তনে তিস্তার স্রোত ছিল সদা বহমান। নদীমাতৃক এই বাংলায়, উত্তরবঙ্গ যেন নদী, ঝোরা, ঝরনা , পুকুর দিয়ে গড়া এক অত্যাশ্চর্য ভুবন। এত নদী, জঙ্গল, পাহাড়, চায়ের বাগান, শস্যক্ষেত্র এবং বহু জাতি-উপজাতি সমন্বয়ে উত্তরবঙ্গ যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমন রহস্যময়। দেবেশ রায় সম্পর্কে বলা যায়, তিনি সাহিত্যিক রূপে সেই অপার রহস্যের শিলালিপি উদ্ধারে ব্রতী ছিলেন।
নদী ও জঙ্গল, খেত ও চাষবাস সম্বল যে জীবন, চায়ের বাগান ও অপাপ সরলতার যে মন ওখানকার অস্তিত্ব ঘিরে, তার বিপরীতে শোষণ ও নিপীড়ন, অত্যাচার ও অনাচার, অন্যায় ও নির্যাতনের দুঃখ তাঁর কলমের কালি হয়ে উঠেছে বার বার। সুন্দর ও সারল্যের পাশপাশি যে বর্বরতার বাস, তাকে তিনি চিরে, ফাটিয়ে, ভেঙে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর রচনা বড় বলিষ্ঠ ও সত্যবাদী। এই সত্য সহ্য করার সাহস যার নেই, সে দেবেশ রায়ের পাঠক হতে পারবে না। তাঁর ভাষা ডুয়ার্সের ঘন সবুজ জঙ্গল ও সরলচিত্ত মানুষগুলির হাসিকান্নার মতোই ঘনবুনট। তাঁকে অনুধাবন করতে চাইলে কেবল উপভোগ্যতা নয়, চাই প্রশিক্ষিত চিন্তন ও সমাজসচেতনতা। তাঁর রচনা কখনও বিশুদ্ধ বিনোদন নয়। সাহিত্যিকের স্তর বিভাজন করলে দেবেশ রায় থাকবেন প্রথম সারির একজন হয়ে।
আনিসুজ্জামান ও দেবেশ রায়ের প্রয়াণ অপূরণীয় ক্ষতি। তবু, বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদান পাঠকের চিরকালীন সম্পদ হয়ে রইল, এই যা সান্ত্বনা।