ফেসবুক থেকে
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল হয়ে যাওয়ায় তখন তুমুল হইচই । দুর্নীতির অভিযোগে দাতা সংস্থাটি তাদের অর্থায়ন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে । পত্রিকাগুলি লীড নিউজ করছে । বাংলাদেশ সরকার প্রকল্পটিতে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে তৎপর । ওই সময়ে খবর এল, বিশ্বব্যাংক ফের পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে । রাজি করানোর নেপথ্য কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অান্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. গওহর রিজভি ।
কীভাবে বিশ্বব্যাংককে ফেরানো হলো তা জানতে সব পত্রিকার সাংবাদিকরা গওহর রিজভির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন । আমি তখন সমকাল পত্রিকার কূটনৈতিক রিপোর্টার । গওহর রিজভির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল । সারওয়ার ভাই তখন সমকালের সম্পাদক । তিনি আমাকে গওহর রিজভির সাক্ষাৎকার নিতে বললেন । সাধারনত গওহর রিজভি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেও এবার মুখ বন্ধ শুধু নয়; টেলিফোন পর্যন্ত ধরছেন না । কারণ মিডিয়ায় কথা বললে আবার যদি বিশ্বব্যাংক ফিরে যায় ! অতি সাবধানতা । কোনও পত্রিকা কিংবা টিভি সাংবাদিকের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন না বলে প্রতীজ্ঞা করেছেন বলে তাঁর দফতরের কর্মকর্তারা আমাকে বলেছেন । তারা আমাকে এটাও বলেন যে, কোনও একজন সাংবাদিকের সঙ্গেও যদি গওহর রিজভি কথা বলেন তবে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন সবার আগে । আদতে তিনি এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনও কধা বলবেন না ।
আমি সারওয়ার ভাইকে বললাম, গওহর রিজভি কারও সঙ্গে কথা বলবেন না । সারওয়ার ভাই নাছোড় বান্ধা । তিনি বলেন, গওহর রিজভির সাক্ষাৎকার ছাড়া আমার অফিসে আসা বন্ধ । তারপর অন্যকাজ । আমি মারাত্মক টেনশনে পড়ে গেলাম । গওহর রিজভির নম্বরে অসংখ্যবার ফোন করি । ফোন বাজে । রিসিভ করেন না । এদিকে, সাক্ষাৎকার ছাড়া অফিসে গেলে সারওয়ার ভাই রেগে যাবেন । আমি এখন কী করি ! সমকালের গেটে চাচার দোকানে চা, সিগারেট খাই ।
অামি সিদ্ধান্ত নিলাম, গওহর রিজভির বাসায় গিয়ে চেষ্টা করে দেখি । সাক্ষাৎকার না পেলে সারওয়ার ভাইকে বলবো, আমার পক্ষে সম্ভব না । গওহর রিজভির পিএসের কাছ থেকে বাসার ঠিকানা নিলাম । গুলশানে বাসা । সমকাল থেকে রিকশা নিয়ে বাসা খোঁজে বের করলাম । গিয়ে দেখি গেটে পুলিশ পাহারা । গওহর রিজভি মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা । পুলিশ পাহারা থাকা স্বাভাবিক । আমি পুলিশকে বললাম, উপদেষ্টা মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো ।
পুলিশ জানতে চায় আমার সঙ্গে উপদেষ্টার এপয়েনমেন্ট আছে কিনা ।
আমি চিন্তা করলাম, এপয়েনমেন্ট নাই বললে পুলিশ বিদায় করে দেবে । মিথ্যার আশ্রয় নিলাম । বললাম, উনি আমাকে আসার জন্য বলেছেন । সময় দিয়েছেন । পুলিশ তখন আমার পরিচয় জানতে চায় । আমি সাংবাদিক বললাম না । সাংবাদিক পরিচয় দিলে স্পর্শকাতর মনে করে ঝামেলা করবে । আমি বললাম, আমার নাম মাসুদ করিম । উপদেষ্টাকে আমার নাম বলেন । নাম বললেই হবে । তাছাড়া, তিনিই তো আমাকে আসতে বলেছেন । আমি তো নিজের থেকে আসিনি ! আমার সুরে বিরক্তি দেখে পুলিশ কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেল । পাছে পুলিশের আচরনের ব্যাপারে উপদেষ্টার কাছে নালিশ করি কিনা !
পুলিশ আমাকে “স্যার আসেন” বলে বাড়ির কমপ্লেক্সের ভেতরে নিয়ে গেল । সেখানে একজন গৃহকর্মি এসে আমার নাম পরিচয় জানতে চাইল । ততক্ষণে পুলিশ গেটে ডিউটিতে ফিরে গেছে । গৃহকর্মি গৃহে গিয়ে গওহর রিজভির কাছে আমার আগমরনর বার্তা পৌঁছে দিল । কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসাল । আমাকে চা বিস্কুট দিয়ে বলে, স্যার আসছেন ।
গওহর রিজভি এলেন । তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ স্মিতহেসে টানাটানা বাংলায় বললেন, কী খবর মাসুদ ?
আমি বললাম, চাকরিটা রক্ষা করেন । আমার চাকরি গেলে আপনার কাছে চলে আসব । তখন চাকরি দিতে হবে ।
তিনি হেসে বলেন, মশকরা করো ! তোমার চাকরি কে খাবে ?
আমি বললাম, কীভাবে বিশ্বব্যাংককে ফেরালেন বিস্তারিত বলেন ।
তিনি বলেন, অনেক কষ্ট হয়েছে । একটা শব্দ যদি এদিক সেদিক করো তবে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ ! আমি স্বস্তি পেলাম । তিনি সবিস্তারে সবকিছু বললেন । তখন রাত আটটা বেজে গেছে । আমি সারওয়ার ভাইকে ফোন করে গওহর রিজভিকে টেলিফোন দিলাম । রিজভি সাহেব বলেন, মাসুদকে আমি সব বলেছি । কোনও কিছু এদিক সেদিক করা যাবে না । সারওয়ার ভাই আশ্বস্ত করলেন ।
আমি অফিসে গিয়ে নিউজ লিখে দিলে সারওয়ার ভাই অন্য নিউজ ফেলে গওহর রিজভির ছবিসহ আমার নিউজ দিলেন । গওহর রিজভির সাক্ষাৎকার ওই সময়ে পাওয়ায় সব সাংবাদিকরা অবাক হলেন । অনেক অফিসে রিপোর্টাররা বসদের বকাও খেয়েছেন ।
রিপোর্টারকে চাপ দিয়ে কাজ আদায় গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের একটা কৌশল । আমি ভাবলাম, সারওয়ার ভাই কঠিন চাপ না দিলে আমি গওহর রিজভির সাক্ষাতকার নেয়ার এমন কৌশল খোঁজার প্রশ্নই আসে না ।
সারওয়ার ভাই সম্পর্কে একটা ঘটনা বললাম । এমন বহু ঘটনা আছে । আজ তাঁর পৃথিবী থেকে বিদায়ের দিনে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি ।
ঢাকা
১৩ অগাস্ট ২০২০