বাংলা সাহিত্যকে যে ক’জন লেখক সমৃদ্ধশালী করেছেন, তার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ অন্যতম। তার লেখনী বাংলা সাহিত্যকে করেছে আরো বেশি সমৃদ্ধশালী। জাদুকরী লেখক হুমায়ূন আহমেদ অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন লেখনী শক্তির অধিকারী ছিলেন। তার লেখনী পদ্ধতি ছিল একেবারেই ভিন্ন, যা পড়ে পাঠকরা কখনো বিরক্ত হতেন না। একজন লেখকের অন্যতম সেরা গুণ হলো তার পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা, যা তিনি তার গল্প-উপন্যাসের বৈচিত্র্য দিয়ে অর্জন করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ সাধারণত খুব সহজ ভাষা ও ছোট ছোট বাক্য লিখতেন। অসাধারণ গল্প বলা ও সে গল্পকে শেষ পর্যন্ত টেনে নেয়ার দারুণ ক্ষমতা ছিল তার। তিনি এমনভাবে লিখেছেন, যা পড়তে গিয়ে পাঠক চোখ সরাতে পারত না। অদ্ভুতভাবে পাঠককে বইয়ের মধ্যে আটকে রাখতে পারতেন তিনি। এ ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। এ জন্যই হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের জাদুকরী লেখক। আর সে কলমের জাদু দিয়ে পাঠককে বইয়ের পাতায় আটকে রেখেছেন। প্রজন্মকে বানিয়েছেন বই পড়ুয়া। তার বই পড়ে হুমায়ূন ভক্ত হয়নি, এমন হয়তো মিলবে না। ছোট ছোট কথার গাঁথুনি এত চমকপ্রদভাবে বইয়ের পাতায় তুলে ধরতেন, যা পাঠককে তার বই পড়তে করেছে আরো বেশি উৎসাহী।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তার পারিবারিকভাবেই। তার পরিবার ছিল সাহিত্যমনা। তাদের বাসায় নিয়মিত সাহিত্যের আসর বসত। সেখানে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর কবিতা লেখার প্রতিযোগিতা হতো।
শৈশবের হুমায়ূন আহমেদ খুব একটা পড়ালেখায় মনোযোগী ছিলেন না। প্রাথমিকের পর তার জীবনের টার্ন ঘুরে যায়। পড়ালেখায় দেন পূর্ণ মনোযোগ। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।
তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছিলেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। সেখানেও মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন,৷ পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে।৷ ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন এবং একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।৷১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করেন।
লেখালেখি যার রক্তে সে কি আর লেখার বাইরে থাকতে পারে। একটা সময় তিনি লেখালেখির পেশনের জায়গায় নিজেকে দেখতে অধ্যাপনা পেশা ছেড়ে দেন। মনোযোগী হন নিজের লেখালেখি নিয়ে। শুরু করেন লেখালেখি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ।
যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ। চলচ্চিত্র নির্মাণে দারুণভাবে সফল হন এ কিংবদন্তি। ‘আগুনের পরশমণি’৷ দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রটি আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নিয়েছিল।
তিনি নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত অনেক চলচ্চিত্র। তার মধ্যে রয়েছে ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’, ‘নন্দিত নরকে’, ‘প্রিয়তমেষু’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ইত্যাদি। এর মধ্যে শ্যামল ছায়া ছিল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এটি অস্কারে বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল।
হুমায়ূন আহমেদ যে শুধু গুণী লেখক আর চলচ্চিত্রকার ছিলেন এমন নয়। তিনি একজন সফল নাট্যকারও। নাট্যকার হিসেবেও তিনি পেয়েছিলেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। এখনো তার নাটকগুলো দর্শককে আন্দোলিত করে। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘সবুজ সাথী’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’, ‘কালা কইতর’, ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘চন্দ্র কারিগর’ ইত্যাদি নাটক দিয়ে ব্যাপক সাড়া জুগিয়েছিলেন দর্শক মনে ।
বহুপ্রতিভাধর হুমায়ূন আহমেদ শুধু চলচ্চিত্র নাটক নিয়েই থেমে থাকেননি, সাহিত্যেও তার প্রতিভার জানান দেন। ১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ হয়। প্রথম বই দিয়েই আলোচনায় আসেন তিনি। শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ূন।
হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে বরাবরই মধ্যবিত্তের গল্প জায়গা পেত। সাধারণ মানুষ নিয়ে তিনি লিখতে পছন্দ করতেন। এ কারণে হয়তো তিনি সাধারণের কাছে এত বেশি পৌঁছেছেন।
তার লেখনীর মধ্যে যেসব চরিত্র পাঠক মনে দাগ কেটে আছে তার মধ্যে আছে, মিসির আলী, হিমু, শুভ্র ইত্যাদি। হিমু চরিত্রকে তরুণ পাঠকের মগজে ও মননে গেঁথে দিয়েছিলেন তিনি। ভক্তদের অন্তরে হুমায়ূন আহমেদ সহস্র বছর বেঁচে থাকবেন তার অসামান্য কৃতিত্বের কারণে। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন হুমায়ূন আহমেদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। নন্দিত এ কথার জাদুকরকে তারই প্রিয় গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বহু প্রতিভাধর এ মানুষটির আজ ৭৭তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
এস/ভি নিউজ