বাংলায় চলছে তখন হোসেন শাহী বংশের রাজত্বকাল। তাদের উদার শাসনামলে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অনেক জ্ঞানী গুণী ও প্রশাসনিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ভারতের নানা অঞ্চল থেকে তাদের দরবারে স্থান পেয়েছিলেন। এ রকমেরই একজন রাজপুত যুবক ছিলেন কালীদাস সিংহ গজদানী। রাজপুতানা থেকে তিনি এই সময় ভাগ্যাস্বষণে বাংলায় এসেছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুলমান হয়েছিলেন এবং নাম ধারণ করেছিলেন সোলায়মান খান। ইনিই বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি ঈসা খাঁর পিতা।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ যখন বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তখন দিল্লি এবং বাংলার রাজনীতিতে চলছিল প্রবল টানাপোড়েন। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। ইসলাম শাহ সিংহাসনে বসেই তাঁর পিতার প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিল করে দেন এবং শামস্উদ্দিন মোহাম্মদ সুর নামে একজন আত্মীয়কে সমগ্র বাংলার গভর্নর বা প্রধান শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। গভর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই শামস্উদ্দিন মোহাম্মদ সুর সমগ্র বাংলায় তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম ভাাটি অঞ্চলে সোলায়মান খানের রাজ্যের প্রতি দৃস্টি দেন এবং সোলায়মানকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করাতে বারবার সসৈন্য অভিযান চালান। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হন। অশেষে কৌশলে সাক্ষাৎকারের কথা বলে ডেকে এনে তাকে হত্যা করেন। ঈসা খাঁর পিতা যখন নিহত হন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৮ কি ১০ বছর।
পিতার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর ঈসা খাঁ ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা ঈসা খাঁর খালু, তরফ রাজ্যের অধিকর্তা হজরত সৈয়দ ইব্রাহীম মালেকুল উলামা -র কাছে মানুষ হতে থাকেন। সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি তাঁর খালা খালুর তত্ত্বাবধানেই থাকেন।
এরপর তাজ খান করবানি যখন বাংলার সিংহাসনে বসেন, তখন ঈসা খাঁ তাঁর পিতার পরিত্যক্ত জায়গির ফিরে পান। তাঁর জায়গির ফিরে পাবার সাল ১৫৬৩ অথবা ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। ঈসা খাঁর এই জায়গির তথা জমিদারি অবস্থিত ছিল বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে। জায়গির ফিরে পাবার পর তিনি কিছু দিন তরফ রাজ্যের সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিচক্ষণতা ও ন্যায়বিচার করার জন্য ওই বয়সেই তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান করবানি মোঘলদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর মোগলরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আফগান রাজত্ব বাংলা থেকে বিলুপ্ত হলেও বাংলার এই অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক জমিদার ও ভূস্বামী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোগল শাসন প্রতিরোধে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে। এদিকে আশ্চর্যজনকভাবে মোগল সেনাপতি শাহবরদি স্বপক্ষ ত্যাগ করে একা¥তা ঘোষণা করেন ঈসা খাঁর সঙ্গে। এই খবর পেয়ে বিশাল মোগল বাহিনী বাংলায় এসে শিবির স্থাপন করে। ভয় পেয়ে স্বপক্ষত্যাগী শাহবরদি আবার ভিড়ে যান মোগলদের সঙ্গে। মোগলরা ভেবেছিলো ঈসা খাঁ তাদের বশ্যতা স্বীকার করবেন। কিন্তু স্বাধীনচেতা ঈসা খাঁ আগ্রাসী মোগল শক্তিকে প্রতিরোধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে শুরু হয় দুই পক্ষের যুদ্ধ। ঈসা খাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে মোগল বাহিনী পলায়ন করে।
উল্লেখ্য, ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বিহার, উড়িষ্যা এবং বাংলার পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে মোগলদের বিরুদ্ধে আফগান ও অন্যান্য জমিদার যখন তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য উপর্যুপরি চেষ্টায় লিপ্ত, তখন ভাটি রাজ্যের অধিপতি ঈসা খাঁ অপেক্ষাকৃত দৃঢ় ও শান্ত অবস্থায় ভাটি রাজ্যকে সুসংহত করে তুলতে শান্তিপুর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করে চলতে থাকেন। পরিশেষে একটি সন্ধির মাধ্যমে ঈসা খাঁ ভাটি রাজ্য পরিচালনার এবং রাজস্ব আদায় করার অধিকার পর্যন্ত লাভ করেন। এইভাবে তিনি বাইশটি পরগনার অধিকর্তা হন।
কিন্তু ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এসে মোগলদের সঙ্গে ঈসা খাঁ বিবাদ চরমে ওঠে। কারণ আর কিছুই নয়, তার স্বাধীন সত্ত্বায় হস্তক্ষেপ, স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনায় বাধাদান। মুলত ১৫৮১ থেকে ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোগলদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত যুদ্ধে ঈসা খাঁ ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশীয় সকল রাজা ও ভুস্বামীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং মোগলদের সঙ্গে নানা পর্যায়ের যুদ্ধে তিনি যে রণকৌশল দেখিয়েছিলেন, এক অর্থে তা বাংলার সামরিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। ঈসা খাঁর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী যে সব অস্ত্র কামান ও রণতরী ব্যবহার করেছিলো এবং এ সংক্রান্ত যে বিবরণ পাওয়া যায়, এক কথায় তা অপুর্ব। যে সব দুর্গ তিনি নির্মাণ করেছিলেন, তাও ঐতিহাসিক ও সামরিক বিচারে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উল্লেখ্য, ঈসা খাঁর আমলে বাংলা সাহিত্যেরও প্রভৃত উন্নতি হয়েছিল। বিকাশ ঘটেছিল স্থাপত্যকলারও।
বাংলার এই বীর স্বাধীনতার যোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন ১৫৯৯ খিষ্টাব্দে।