প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যে বৈঠক হয়েছে৷ সেখানে পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা৷
এদিকে, এই বৈঠক নিয়ে ভারতের চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করেন দেশটির একজন বিশ্লেষক৷
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আছেন৷ মঙ্গলবার বৈঠকটি সেখানেই হয়েছে৷ বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, আলোচনা কী নিয়ে হয়েছে তার চেয়ে ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’-এ আরো বেশি কিছু প্রকাশ করেছেন জো বাইডেন৷ তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এবং ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন আদায় করেছেন৷ ফলে ইউনূস সরকারের এখনকার কাজ হলো, এই সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সব ধরনের সংস্কারে সহযোগিতা নেওয়া৷
‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বিস্মিত করেছে’
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘‘ড. ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমাকে বিস্মিত করেছে৷ জড়িয়ে ধরা, গলায় হাত রাখা, এরকমটি সাধারণভাবে দেখা যায় না৷ এর মধ্য দিয়ে বোঝা যায় অন্তর্বর্তী সরকার ও সংস্কারকে পুরো সমর্থন দিয়েছে তারা৷ এখন সরকারের দায়িত্ব হবে এই সমর্থন কাজে লাগিয়ে সংস্কারের কাজ করা৷”
তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা হয়েছে৷ আশা করি এখন এই সংকট নিরসনে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে৷ জিএসপি সুবিধা নিতে কাজ করতে হবে৷ অর্থনৈতিক সংস্কার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য কাজে লাগাতে হবে৷”
মো. শহীদুল হক মনে করছেন, ‘‘এখানে ভূরাজনীতির একটা ভারসাম্য হবে৷ ভারত আর এককভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না৷ যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বাইডেন৷ কিন্তু বাইডেন বাংলাদেশের ব্যাপারে তার সমর্থন স্পষ্ট করেছেন৷ আর যদি কমলা হ্যারিস ক্ষমতায় আসেন তাহলে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে৷”
তবে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত৷ ‘‘মার্কিন স্বার্থের জায়গাগুলো বুঝতে হবে৷ সেইখানে বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে হবে,” বলেন তিনি৷
‘অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের এত সমর্থন বাংলাদেশ কখনো পায়নি’
আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এম রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘শুধু বাইডেন নয়, অন্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে বৈঠক হয়েছে তাতেও স্পষ্ট যে, সারা বিশ্বের সমর্থন আছে তার ও তার সরকারের প্রতি৷ এখন অ্যামেরিকা ও ইউরোপ সমানভাবে ইউনূসের সঙ্গে আছেন৷ সেটা কতটা দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগানো যায় সেটাই দেখার বিষয়৷”
তিনি বলেন, ‘‘দেশের অর্থনীতিতে পোশাক খাতের একটা বড় অবদান আছে৷ যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসাবে আমাদের তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা৷ ইউরোপে আমাদের বড় বাজার৷ এই বাজারগুলোতে আমাদের অবস্থান আরো শক্ত করতে হবে৷ আর বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আছে৷”
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশ নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে৷ পোশাক খাত নিয়েও হচ্ছে৷ আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সেটা আছে৷ তবে মার্কিন ও ইউরোপের এই সমর্থনে বাংলাদেশ সেটা কাটিয়ে উঠবে আশা করি৷”
সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এম রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘‘অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের এত সমর্থন বাংলাদেশ কখনো পায়নি৷ জো বাইডেনের যে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ড. ইউনূসের সঙ্গে, তা অনবদ্য৷ এটা বলে দেয় তার এগিয়ে যাওয়ার পথে সব ধরনের সমর্থন দেবে যুক্তরাষ্ট্র৷”
ইউনূস-মোদী প্রসঙ্গ
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস৷ সেটি হয়নি৷ এটাকে রাশেদ আহমেদ চৌধুরী দেখছেন মোদীর হীনমন্যতা হিসাবে৷ তিনি বলেন, ‘‘মোদী সরকার পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ন্যাক্কারজনকভাবে সমর্থন দিয়েছিল৷ এখন আবার আশ্রয় দিয়েছে৷ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করলে এই বিষয়গুলো উঠতো ভেবেই হয়তো মোদী ইউনূসকে সাক্ষাতের সময় দেননি৷ আবার এও হতে পারে যে, ভারত এখনো চাইছে তার দাদাগিরি ধরে রাখতে৷ কিন্তু তাতে ভারত আর সফল হবে বলে মনে হয় না৷”
তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোফাজ্জল করিম বলেন, ‘‘ভারত এই বৈঠক না করার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে৷ তারা বলেছে ড. ইউনূস যখন পৌঁছাবেন মোদী তখন চলে আসবেন৷ ফলে দুইজনের মধ্যে সাক্ষাতের সুযোগ নেই৷ তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকরের মধ্যে তো বৈঠক হয়েছে৷ আমার মনে হয় মোদী ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করেননি৷ তবে এটাও ঠিক, তাদের মুখে এক কথা এবং অন্তরে আরেক৷”
তার কথা, ‘‘বাংলাদেশ এবার হাইলাইটেড৷ ড. ইউনূস নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব৷ যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে৷ সেই কারণে কেউ হীনমন্যতায় ভুগলেও ভুগতে পারেন৷”
‘ভারতের চিন্তার কারণ নেই’
এদিকে, ভারতের ও পি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডয়চে ভেলে বাংলার নতুনদিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়কে বলেছেন, ইউনূস-বাইডেন বৈঠক নিয়ে ভারতের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ বরং ভারত অত্যন্ত ইতিবাচক দিক থেকে বিষয়টি দেখছে বলেও মনে করেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘ড. ইউনূসের একটা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে৷ যুক্তরাষ্ট্র তাকে সমর্থন করছে৷ তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত ছিল বলে আগে জানিয়েছিল৷ ইউনূস ও বাইডেনের মধ্যে আলোচনায় সংস্কারের বিষয়টি ছিল৷ এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক৷ ড. ইউনূস যদি ইতিবাচক সংস্কার করেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন করবে৷ তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থসাহায্য করতে পারে৷ বাংলাদেশ তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ এরপর যদি ড. ইউনূস অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেন, সেদিকেও যুক্তরাষ্ট্রের নজর থাকবে বলে মনে হয়৷”
সূত্রঃ ডয়চে ভেল
এস/ভি নিউজ