বৈশ্বিক পাওয়ার পলিটিকসের তত্ত্বগত পাঁচটি পন্থা বা মডেলের মধ্যে অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন মডেলের সূত্র ধরে ৯/১১ এবং তারপর যা ঘটেছে তার পরিসমাপ্তি এখনো হয়নি। বিশেষ করে নন-স্টেট অ্যাক্টর, অর্থাৎ স্বীকৃত রাষ্ট্রশক্তিবহির্ভূত কোনো গোষ্ঠী বা শক্তি যখন এই অ্যাকশন-রিঅ্যাকশনের ক্ষমতা অর্জন করে, তখন সেটি ভয়ংকর হয়ে ওঠে এবং তার পরিসমাপ্তির কোনো প্রিডিকশন করা যায় না। সুতরাং এ রকম অভিশপ্ত ঘটনা থেকে ভবিষ্যতে যদি বিশ্ব মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে হয় তাহলে এযাবত্কালের সর্ববৃহৎ সন্ত্রাসী ঘটনা ৯/১১-র প্রেক্ষাপট, তার পরিণত এবং সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের বর্তমান অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ৯/১১ হঠাৎ করে অথবা কোনো রকম পূর্বাভাস ব্যতিরেকেই ঘটে গেছে, এমনটি বলার সুযোগ নেই। প্রেক্ষাপটের সামগ্রিকতার লিগেসি অনেক পুরনো।
আলেকজান্ডারের এশিয়া অভিযান, রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন কর্তৃক চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে খ্রিস্টান ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা, ৮০০ সালে ইউরোপব্যাপী হোলি রোমান এমপায়ার প্রতিষ্ঠা, আরবে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসক কর্তৃক ইউরোপ পর্যন্ত খেলাফতের বিস্তার, একাদশ শতাব্দীতে হোলি রোমান এমপায়ার ও আরব খেলাফতের মধ্যে কয়েকটি ক্রুসেড, তুরস্কের অটোমানদের ইউরোপ অভিযান, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওয়াহাবি মতবাদ বলে ইসলামের চরম কট্টর ধর্মীয় মতবাদের জন্ম, মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রায় সব মুসলিমপ্রধান দেশে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, অন্যায়ভাবে একটা প্রতিষ্ঠিত মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক উত্খাত করে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্টের মধ্যে শীতল ও প্রক্সি যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের প্রাধান্যতা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৯/১১-র প্রেক্ষাপট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। বিশাল প্রেক্ষাপট। আর বিশাল বিষয় বলেই এর কোনো সহজ সমাধান নেই। কলামের সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। তার আগে একটা বই থেকে একটা উদ্ধৃতি উল্লেখ করব, যেটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। ‘দ্য ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অব দ্য রোমান এম্পায়ার’ নামের বইটি লিখেছেন এডওয়ার্ড গিবন। ছয় খণ্ডে প্রকাশকাল ১৭৭৬-৮৮। গিবনের কনক্লুসিভ মন্তব্য, ‘প্রাচীন গ্রিকদের ধর্মনিরপেক্ষ আলোকিত মূল্যবোধ ত্যাগ করে অন্ধত্ব, অসহিষ্ণুতা এবং খ্রিস্টান ধর্মবাদী দর্শনকে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক উপাদান হিসেবে গ্রহণ করায় রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত হয়।’ তার পর থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত-সংঘর্ষ, ধ্বংসযজ্ঞ ইত্যাদির এক নম্বর কারণ হিসেবে কাজ করেছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি, যেখানে ধর্মের অপব্যবহার করে রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা হয়েছে। ঠিক এ কারণেই সত্তর-আশির দশকে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ৯/১১-র সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সত্তর ও আশির দশকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ ছিল তুঙ্গে। অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন মডেলের সূত্রেই ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নেয়। পাকিস্তানে তখন সদ্য ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক নিজের অবৈধ ক্ষমতাকে সুসংহত করার মোক্ষম অস্ত্র হাতে পেয়ে যান। নাস্তিক কমিউনিস্ট দোরগোড়ায়, ইসলাম ধর্ম আর থাকবে না। আমেরিকা উপলব্ধি করে, সোভিয়েতকে শায়েস্তা করার এটাই বড় অস্ত্র। ইসলাম রক্ষায় পাকিস্তান আর সৌদি আরবকে নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। এভাবেই আফগানিস্তান হয়ে পড়ে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টির সর্বোত্তম ভূমি এবং শুরু হয় সশস্ত্র জঙ্গিবাদের বিশ্বায়ন। আমেরিকার অস্ত্র, সৌদির অর্থ, আর পাকিস্তানের তত্ত্বাবধানে সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার উগ্রবাদী মুসলমান যুবক জিহাদি মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ওসামা বিন লাদেনের উত্থান এবং আল-কায়েদার জন্ম হয়।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত সেনাবাহিনী প্রত্যাহৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে একপর্যায়ে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় চরম উগ্রবাদী ওয়াহাবিতন্ত্রে বিশ্বাসী তালেবান গোষ্ঠী। আফগানিস্তানে বসেই ১৯৯৮ সালে ওসামা বিন লাদেন বন্দুক ঘুরিয়ে ফেলে। ফতোয়া দেয়, আমেরিকা আর ইহুদিরা ইসলাম ধর্মের চিরশত্রু, তাদের হত্যা করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। তারপর পর্যায়ক্রমে একেকটা ঘটনার সূত্র ধরেই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঘটে সেই ভয়াবহ ঘটনা। একাধিক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ছিনতাই করে সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী আক্রমণের মাধ্যমে আমেরিকার গর্ব নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। তাতে তিন হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হয়। আক্রমণের জন্য আল-কায়েদার নামে দায় স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি পাওয়া যায়। আপাত দৃশ্যমান ব্যাকগ্রাউন্ড পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং স্বীকারোক্তিতে ধরে নিতে হয় আল-কায়েদাই এ কাজ করেছে। তবে এ ঘটনার ওপর ২০০৪ সালে মাইকেল মুর নির্মিত দুই ঘণ্টা তিন মিনিটের ডকুমেন্টারি ‘ফারেনহাইট ৯/১১’ এবং ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের অব্যবহিত পর দু-তিন দিন মার্কিন প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপ দেখে ও পর্যালোচনা করে কেউ ভিন্নমত দিলে বা কেউ এটিকে রহস্যময় বললে তাকে অমূলক বলা কঠিন হবে। ৯/১১ ঘটনার পরিণতিতে কয়েকটি চিত্র আমাদের সামনে এখন দেখতে পাই। আমেরিকার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। মুখ ফসকে এটিকে একবার ক্রুসেড বলে ফেলেন; যদিও এ কথাটি দ্বিতীয়বার তিনি আর বলেননি। তালেবান ক্ষমতা থেকে উত্খাত হয়। আমেরিকান সেনাবাহিনী ন্যাটো মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নেয়। আমেরিকার প্রায় আড়াই হাজার সেনা নিহত, যুদ্ধে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়, আফগানিস্তান পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস, কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত ও আরো কয়েক লাখ বাস্তুচ্যুত এবং ১৯ বছরের মাথায় আমেরিকান পৌরোহিত্যে বর্বর জঙ্গিবাদের মূল তালেবান গোষ্ঠী আবার আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার দ্বারপ্রান্তে।
তাহলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্জন কী হলো। ইরাকের মতো উন্নত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে তিন খণ্ডে বিভক্ত হওয়ার কাছাকাছি, অনবরত রক্তক্ষরণ চলছে। সিরিয়ার মতো আরেকটি উদার ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, যুদ্ধ এখনো চলছে। তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ লিবিয়া ধ্বংস, ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত এবং খণ্ডিত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সীমাহীন গৃহযুদ্ধে মানবতা ভূলুণ্ঠিত। পারস্য উপসাগরের তেল ও গ্যাস সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসরায়েলের আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একটা টেকসই রাষ্ট্র পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের আশা ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সর্বসাকল্যে যুদ্ধকবলিত দেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী দীর্ঘদিন যাবৎ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
দ্বিতীয় চিত্রটি হলো, আফগানিস্তানে জিহাদে যোগ দেওয়া লক্ষাধিক জঙ্গি দেশে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা শুরু করেছে। এই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। হোলি আর্টিজানের মতো ঘটনা এখানে ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়ার ইন্দোনেশিয়াসহ সব মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে আফগান প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের সশস্ত্র তৎপরতার মধ্য দিয়ে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদের বিশ্বায়ন ঘটেছে। সোমালিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া, সুদান, মালি, বারকিনাফাসো, নাইজেরিয়া ও নাইজারে এই করোনার মধ্যেও জঙ্গি তৎপরতায় প্রতিনিয়তই নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছে। তৃতীয় চিত্রটি হলো, পশ্চিমা বিশ্বে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটেছে। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে আক্রমণের মধ্য দিয়ে সেটির বীভৎস রূপ দেখা যায়। উদার বলে পরিচিত ইউরোপের দেশগুলোতে অভিবাসী ও মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক শক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের কিছু বুদ্ধিজীবীও তাঁদের লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মবিদ্বেষ উসকে দিচ্ছেন, যাকে তাঁরা ক্লাস অব সিভিলাইজেশন হিসেবে উপস্থাপন করছেন। তাঁদের লেখা পড়লে মনে হয়, পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে মুসলমানরাই বোধ হয় এখন প্রধান শত্রু। অথচ সারা বিশ্বের শতকরা ৫ ভাগ মুসলমানও উগ্রবাদিতা ও ধর্মবিদ্বেষ সমর্থন করে না। তাঁরা উমাইয়া, আব্বাসীয় ও অটোমানদের ইউরোপ অভিযানের চিত্রটি একতরফাভাবে তুলে ধরছেন। তাতে খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গবাদীরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে। ইউরোপ কর্তৃক দীর্ঘকাল মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর ওপর ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও লুণ্ঠনের চিত্রটি পাশাপাশি তুলে ধরলে নতুন প্রজন্ম বুঝত সব কিছু হয়েছে দুই পক্ষের শাসকদের রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য। তাঁরা সবাই রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার করেছেন, ধর্মকে অপবিত্র করেছেন।
সব পক্ষের উসকানিমূলক বুদ্ধিচর্চার পরিণতি সম্পর্কে এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর লেখা ‘কাভারিং ইসলাম’ গ্রন্থে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। ৯/১১-র সার্বিক প্রেক্ষাপট প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এখনো বিদ্যমান। নতুনরূপে নতুন নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে। ৯/১১ ও তার পরিণতির সব কিছুই স্ফুলিঙ্গ হয়ে আছে। বিশ্ব আরো অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকছে। তাই মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সার্বিক বিশ্বব্যবস্থায় বিশাল সংস্কার প্রয়োজন। জাতিসংঘকে ঢেলে সাজাতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের সংখ্যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। ভেটো ক্ষমতা বিলুপ্তিসহ স্থায়ী-অস্থায়ী সব সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে জাতিসংঘের স্বাধীন ম্যাকানিজম থাকলে অনেক কিছুর পরিবর্তন হবে। ৯/১১-র অভিশাপ থেকে ১৯ বছরেও কিন্তু বিশ্ব মুক্ত হতে পারেনি।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক